সাতসতেরো

নিগার সুলতানার শখ ও স্বপ্নের উদ্যোগ ‘অনুমেঘা’

মানুষ টাকা জমাতে চায়, কবি হেলাল হাফিজ মানুষ জমাতে চেয়েছেন আর গ্রাফিক ডিজাইনার নিগার সুলতানা জমা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন। এই উদ্যোক্তা টাই ডাই, ব্লক এবং সুতার কাজের মিশেলে তৈরি করেন নারীদের পোশাক। ডিজাইন করেন নিজেই। ‘অনুমেঘা’ ফ্যাশন হাউসের স্বত্বাধিকারী তিনি। অনুমেঘা শব্দটি হিন্দি এর অর্থ হলো সফল বা বিজয়। চলতি বছরেই শুরু হয় অনুমেঘার পথচলা। 

ইটিইতে বিএসসি কমপ্লিট করেছেন নিগার সুলতানা। ৯টা ৫টা চাকরি পছন্দ নয় তার। এজন্যই নিজে যে সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছেন সেই রিলেটেড চাকরি করেননি। বড় হয়েছেন মফস্বলে। ছোটবেলা থেকেই রং এর প্রতি দূর্বলতা তার। তিনি বলেন ‘রং নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে আমার, পৃথিবীর প্রতিটা রংই সুন্দর, আমি ফুল, লতা পাতা বা এক টুকরো মাটিতেও বিভিন্ন রং এর শেড দেখি। বিভিন্ন রং আঁকি বুকি দিখে মুগ্ধ হয়ে।’

নিগার সুলতানা জানালেন, শুরুতে ভেবেছিলেন শাড়ি নিয়ে কাজ করবেন কিন্তু কাজ শুরু করার পরে ক্রেতাদের চাহিদা বুঝতে পেরে নারীদের প্রায় সব ধরনের পোশাক নিয়ে কাজ শুরু করেন। যেমন থ্রি-পিস, টপস, কুর্তি, স্কার্ট, কাবলি প্যান্ট, কো-অর্ড এবং শাড়ি। 

নিগার সুলতানা বলেন, ‘সুতি আমার প্রথম পছন্দ। শাড়ির জন্য বেছে নিয়েছি টাংগাইল তাঁত, খাদি এবং কটন। জামার জন্য বেক্সি ফেব্রিক্স, খাদি এবং লিলেনে কাজ করেছি। ব্লক বা স্ক্রিন প্রিন্টের সাথে সুতা আর ডাইয়ের সংস্পর্শে নতুন কিছু করতে চাই সবসময়। সবকিছুই আমার ডিজাইনে করা।

শুরুর গল্প জানতে চাইলে নিগার সুলতানা বলেন, ‘শুরুর গল্প বলতে হলে অনেক পেছনে যেতে হবে। একদম স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই আমি পোশাক ডিজাইন করতাম। আমার ভালো লাগতো কাজটা করতে কিন্তু কখনোই মাথায় আসেনি যে আমি পোশাক নিয়ে কাজ করবো। আমি টিচিং প্রফেশনে ছিলাম সেটা ছেড়ে গ্রাফিক ডিজাইনের একটা কোর্স করি তারপর পুরোদমে একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে থাকি। ফাইভারে লেভেল টু সেলার আমি, আপওয়ার্ক এবং ফ্রিল্যান্সিং ডট কমেও কাজ করেছি আর ফ্রিল্যান্সিং করার ফাঁকে ফাঁকে নিজের একটা ফ্যাশন হাউজের স্বপ্ন দেখতাম। বায়ারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ড্রেসের ডিজাইন রেডি করতাম। আমি কাজ শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রচুর ডিজাইন রেডি করে রেখেছিলাম। যখন শুরু করলাম ফিক্সড কোনো অ্যামাউন্ট নিয়ে কাজ শুরু করিনি। আমি যখন আমার এই কাজের কথা আমার হাজব্যান্ডের সাথে শেয়ার করি তখন, সে আমাকে ৪৫,০০০ টাকা দিয়েছিলো।’ 

নিগার সুলতানা এক মাসে সর্ব্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। এই কাজ শুরুর আগে তিনি সিটি আলোর একটা কোর্স করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে নিগার সুলতানা বলেন, ‘সত্য কথা বলতে একটা ব্যাবসা কীভাবে শুরু করবো, কই থেকে কী করবো আমার কোনো ধারনাই ছিলো না। কোর্সে আমি অনেক কিছু জেনেছি । যা জেনেছি তা একটা রানিং বিজনেসের জন্য প্রচুর হেল্পফুল ছিলো কিন্তু তখনও আমি কিছুই শুরু করিনি। আমি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছি এই অল্প সময়ে খেয়াল করে দেখেছি একজন কাস্টমার ভিন্ন ভিন্ন জিনিস চাইছেন। যেমন হয়তো একজন ক্রেতা প্রথম একটা শাড়ি নিলো, এরপরই এসে টপস বা প্যান্ট চাইছেন। অনেকেই টপসের সাথে মিলিয়ে প্যান্ট, ওড়না করে দিতে বলেন। এই সব চাহিদা পূরণ করতে করতেই আমার কাজের পরিধি বেড়েছে। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাক তৈরি করে দেওয়ার অপশন গুলো রেখেছি। কাস্টোমাইজ অর্ডারও নিচ্ছি।’ 

নিগার জানালেন, নিয়মিত যারা ঘরের বাইরে যান তারা লিলেনে ডাই করা কাবলি প্যান্টগুলো বেশি নিচ্ছেন। এ ছাড়া শাড়ি, থ্রি-পিস সবকিছুইরই ক্রেতা আছে।

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য নিগার সুলতানাকে সহযোগিতা দিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী। 

নিগার বলেন, ‘আমার সব কাজেই প্রথম যে সহযোগিতার হাত বাড়ায় সে হলো আমার লাইফ পার্টনার। আমি যে কাজেই হাত দেই সে সবসময় বলতো, শুরু করো তুমি পারবে। যখন যে জায়গায় আমার হেল্প লাগে সে সব কিছুতেই সাপোর্ট দেয়। আরো কয়েকজনের নাম বলতেই হয় যারা একই সেক্টরে থেকেও আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। কখনো সোর্স জানিয়ে কখনো পরামর্শ দিয়ে। তারা হলেন, রিমু আপু, সাম্য, ছোট ভাই অতুল। ডলি আপু ছিলো, আছে ছায়া হয়ে আমার।’

নিগার সুলতানা জানান, প্রতিযোগিতা তার নিজের সাথেই। তার অনেক কাজ এখনো পরে আছে যেগুলোর কোন ছবি তিনি অনুমেঘার পেইজে দেননি। এর কারণ কাজটা তার ভালোলাগেনি। তিনি মনে করেছেন, তার চাহিদা অনুযায়ী কারিগর আউটপুট দিতে পারেননি। 

নিগার সুলতানা বলেন, ‘যে কাজ দেখে আমার পছন্দ হয় না সেই কাজ আমি এক পাশে ফেলে রেখে নতুন কাজে হাত দেই।’

ভালো কারিগর না পাওয়াকে প্রতিকূলতা বলে মনে করেন নিগার। তিনি বলেন, ‘অনেক সময়  কারিগররা সময়মত কাজ করে দিতে পারেন না। দেখা যায় যে, স্ক্রিন প্রিন্ট আর ব্লক প্রিন্টে কাপড় নষ্ট করে ফেলেন। অনুমেঘার প্রতিটা প্রিন্ট ডিজাইন আমার নিজের করা। একারনে কাজ সামলাতে একটু হিমশিম খাই।’

প্রতিকূলতা আছে কিন্তু প্রাপ্তি মোটেও কম না। নিগার সুলতানা বলেন, ‘কাজ শুরু করেছি এক বছরও হয়নি এর মাঝে প্রাপ্তির ঝুলিটা খুব ছোট না। আমার রিপিট কাস্টমার বেশি। আমি এখনো অনলাইন বেইজ কাজ করছি, মার্কেটিং বলতে বিভিন্ন গ্রুপে আমার প্রোডাক্টের ছবি দেই, ভালো লাগে যখন অনেকেই কমেন্ট করে, প্রোডাক্ট দেখেই বুজতে পেরেছি এটা অনুমেঘার। আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম অনুমেঘার শাড়ি পরে সেখানে অভিনেত্রী শম্পা রেজার সাথে দেখা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ, উনি আমার শাড়ি দেখিয়ে বললেন তোমার শাড়িটা তো খুব সুন্দর, কই থেকে নিয়েছো? জানালাম আমার নিজের কাজ অনেক প্রশংশা করে বললেন এই শাড়িটা আমি নিতে চাই, প্রচন্ড মন খারাপ হলো আমার কারণ শাড়িটা তখন স্টক আউট, উনাকে জানানোর পর বললো তোমার আরো কিছু কাজ দেখাও আমি আমার ছেলের বউ এর জন্য একটা শাড়ি নিতে চাই, সেদিন রাতেই উনার ছেলের বউ দেশে আসবেন, উনি আমার আরেকটি শাড়ি পছন্দ করে বললেন পাঠিয়ে দিতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে আদর, আমার কাজে প্রচুর অনুপ্রেরণা দেয়, বাসায় প্রোডাক্টের যত ছবি তোলা হয় সব সে তুলে দেয়। আমার কাজ দেখে তার মতামত দেয়। অনুমেঘার শাড়ি, ড্রেস আমি পরলেই সে বলবে মা সুন্দর করে দাঁড়াও আমি ছবি তুলে দিচ্ছি। ছেলে আর তার বাবার সহযোগিতা ছাড়া দুটো প্রফেশন চালিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব হতো না।’

একটু একটু করে নিগার সুলতানার কাজের পরিধি বাড়ছে।  নিগার সুলতানার কাজের সঙ্গে নিয়মিত ছয় জন যুক্ত রয়েছেন। ডাইং এর জন্য দুজন। সুতার কাজের জন্য তিনজন এবং একজন টেইলার। মাসে কখনো  ৮০ হাজার টাকা সেল হয় আবার কখনো তার বেশি। 

নিগার সুলতানা বলেন, ‘আমার প্রতিটা ড্রেসের ডিজাইন নিজের তৈরি কার, নতুন ডিজাইন আনা সময় সাপেক্ষ। কাজের বয়সটা খুব বেশি না আর গোছানো কাজ পছন্দ আমার, গুছিয়ে কাজ করছি বলেই একটু সময় লাগছে পেইজটাকে একটা স্ট্যাবল জায়গায় নিতে। প্রফেশনের দিক থেকে, ফ্রিল্যান্সিং আমার প্রথম প্রায়োরিরিট। অনুমেঘাকে এখনো শখের জায়গা বলা যায়, তাই সেল যা হয় তাতেই আনন্দ পাই। এখনো কোন টার্গেট সেট করিনি। ছেলে ‘এটু’ দেবে, তারপর দেশের বাইরে যাওয়ার চিন্তা ওর। সে কারনে ছেলেকে সময় দিচ্ছি বেশি। ফ্রিল্যান্সিং, ছেলে, সংসার সামলেই অনুমেঘার কাজ করছি। অনেকে পরামর্শ দেয় আলাদা করে ডিজাইনারের সহযোগিতা নিতে কিন্তু ডিজাইন করতে ভালো লাগে বলেই আমার অনুমেঘার পথ চলা শুরু। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেল আড়াই লাখ ছিলো, আলহামদুলিল্লাহ!’

নিগার সুলতানা ব্যবসায়ের মূলধন এখনো রোলিং করছেন। এই উদ্যোক্তা বলেন,  ‘আমার কাজের মধ্যে একটা বিষয় খুব খেয়াল রাখি তা হলো সোর্স, কারিগরের টাকা কখনোই বাকি রাখি না। সেটা সাথে সাথেই পরিশোধ করে দেই। এতে বুঝতে পারি আমি লসে নেই।’

নিগার সুলতানা শখ থেকে শুরু করে আরও ছয় জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পেরেছেন। তার সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পারছেন; এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে একটি শখ ও স্বপ্নের উদ্যোগ।