কোথাও যখন অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছিলেন না তখন দুই বল বয়কে নিয়ে একাই মিরপুরের ইনডোরে চলে যান মুশফিকুর রহিম। ওখানে উইকেটও অপ্রস্তুত! বলে কয়ে কোনো রকম ঠিকঠাক করে মুশফিক চালিয়ে নেন নিজের অনুশীলন। অপ্রস্তুত উইকেটে ব্যাটিং কঠিন। সেই কাজটা অনায়েসে ঘণ্টা দেড়েক সময় ধরে করেন মিস্টার ডিপেন্ডবল।
গত জুনের ঘটনা সেটি। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে ছুটিতে ছিলেন। মুশফিক টি-টোয়েন্টি ছেড়েছেন লম্বা সময় আগে। তার অনুশীলনের তেমন সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে নিজের ইন্তেজামে চলে অনুশীলন। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের জন্য তাকে অনুশীলনের সুযোগ দেয় বিসিবি। বাংলাদেশ টাইগার্সের ক্যাম্পে তাকে যুক্ত করে। চট্টগ্রামে এইচপি দলের সঙ্গে মুশফিক খেলেন প্রস্তুতি ম্যাচ।
এরপর পাকিস্তানে ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলেন বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে। প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে রান পাওয়া তার জন্য বড় বিষয় ছিল না। বড় বিষয় ছিল ম্যাচ পরিস্থিতিতে অনুশীলন করা। সেই সুযোগগুলো কতটা কার্যকরী হয়েছে তা বোঝা গেল রাওয়ালপিণ্ডির ২২ গজে মুশফিকের ১৯১ রানের ঝকঝকে ইনিংসে। এই টেস্টের আগে মুশফিক আঙুলে ব্যথা পেয়েছিলেন। খেলা নিয়ে ছিল সংশয়। অথচ ২২ গজে নেমে তার অনবদ্য ১৯১ রানে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে করে ৫৬৫ রান। প্রথম ইনিংসে লিড ১১৭ রানের। যার বড় কৃতিত্ব মুশফিকের।
ক্যারিয়ারের চতুর্থ ডাবল সেঞ্চুরি মিস করে এক আকাশ আক্ষেপ থাকবে তার। কিন্তু দিন শেষে দলের অবস্থান দেখলে নিশ্চয়ই সেই আক্ষেপে প্রলেপ পড়বে। টেস্টে বাংলাদেশ এক ইনিংসে ৫০০ রান তুলেছে, আর সেই ইনিংসে মুশফিক বড় ইনিংস খেলেননি, এমনটা খুব কম হয়েছে। টেস্টে ১২ বারের মতো এক ইনিংসে ৫০০ বা এর চেয়ে বেশি রান তুলেছে বাংলাদেশ। যেখানে মুশফিকুর রহিমের বড় ইনিংস আছে নয়টি। বুঝে নিন টেস্টে এই খেলোয়াড়ের একাগ্রতা কতটা বেশি।
পরিশ্রম তাকে কোথায় নিয়ে গেছে। বরাবরই মুশফিক বলেন তার সামর্থ্য কম, মেধা কম তাই অনুশীলনের প্রয়োজন হয় বেশি। বরং সতীর্থতা বলেন মুশফিক শৃঙ্খল, তার নিবেদন বেশি। তাই পরিশ্রমটাও বেশি। মুশফিক যখন উইকেটে আসেন, তখন বাংলাদেশের রান ৩ উইকেটে ১৪৭। সেখান থেকে মুশফিক উইকেটে থাকেন ৫২৮ রান পর্যন্ত। ৫১৫ মিনিট ক্রিজে থেকে সাদমান, সাকিব, লিটন, মেহেদীর সঙ্গে জুটি গড়েন। যেখানে মিরাজের সঙ্গেই তার জুটি ১৯৬ রানের।
আগের দিনের ৫২ রানের সঙ্গে লিটন ৪ রান যোগ করেন ফেরেন সাজঘরে। যেই নাসিম শাহর ওভার থেকে গতকাল ১৮ রান তুলেছিলেন সেই নাসিমই তাকে সাজঘরের পথ দেখান। শরীর ঘেঁষা বাউন্সার বল জায়গায় দাঁড়িয়ে কাট করতে গিয়ে লিটন আউট হন ৫৬ রানে। এরপর মুশফিক ও মিরাজ এলোমেলো করে দেন পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে তারা প্রতিরোধ গড়েন। সিঙ্গেল-ডাবলসের সঙ্গে বাউন্ডারির ফুলঝুরিতে পাকিস্তানের চার পেসারের সঙ্গে দুই স্পিনারের আক্রমণ একেবারে নির্বিষ করে দেন।
প্রথম সেশনে মুশফিক তুলে নেন সেঞ্চুরি নাম্বর ইলেভেন। এরপর দ্বিতীয় সেশনে পেরিয়ে যান দেড়শ। ওদিকে মিরাজ তুলে নেন ফিফটি। দ্বিতীয় সেশনে কোনো উইকেট না হারিয়ে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে যোগ হয় ১০৬ রান। এরপর কেবল মুশফিকের ডাবল ও মিরাজের সেঞ্চুরির অপেক্ষা। সবই চলছিল ঠিকঠাক। মুশফিক একশ নব্বইয়ের ঘরেই গিয়ে হারান মনোযোগ। স্টাম্পের একটু বাইরে বলে কাট করার চেষ্টা করেন। বাড়তি লাফিয়ে মুশফিকের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল আশ্রয় নেয় কিপারের গ্লাভসে। ২২ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ম্যারাথন ইনিংসটি থেমে যায় ওখানে।
ক্যাচ নিয়ে উল্লাসে মাতার পর রিজওয়ান এসে তাকে জানান অভিনন্দন। শুধু রিজওয়ান নন, গ্যালারিতে উপস্থিত পাকিস্তানি-বাংলাদেশি সমথর্করা তাকে করতালিতে বরণ করে নেয়। ড্রেসিংরুমে সবাই দাঁড়িয়ে মুশফিককে জানান অভিনন্দন। দুর্দান্ত ইনিংসটির সমাপ্ত হয় দূর্বল এক শটে। এই আফসোস তার কেটে যায় দলের সামগ্রিক চিত্রে।
শেষ বিকেলে পাকিস্তান ব্যাটিংয়ে নেমে ১ উইকেট হারিয়ে ২৩ রান তুলেছে। স্বাগতিকরা আরো ৯৪ রান পিছিয়ে। রোববার পঞ্চম দিনে অপ্রত্যাশিত কিছু না হলে ম্যাচের সাম্ভাব্য ফল ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট ড্র বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন হিসেবেই বিবেচিত থাকবে। সঙ্গে মুশফিকের ইনিংসটি চেরি অন দ্য টপ।