বেদনার ২৩ বছর পেরিয়ে অবশেষে পাকিস্তানের মাটিতে জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ, যা টেস্ট ইতিহাসের অবিশ্বাস্য সাফল্যের একটি। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তান গিয়েছে এবং হতাশ হয়ে ফিরেছে। শুধু পাকিস্তানেই নয়, দেশের মাটিতে ব্যর্থতার স্তুপে চাপা পড়তে হয়েছে। সব মিলিয়ে সাদা পোশাকেই সংখ্যাটা শুধু ১৩। এছাড়া পাকিস্তানের মাটিতে ২১ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হার!
পরাজয়ের দুঃস্মৃতি, ব্যর্থতার মিছিল, হতাশায় মোড়ানো অধ্যায় অবশেষে শেষ হলো। এবার জয়ের ছবি আঁকল রাওয়ালপিন্ডির ক্যানভাসে। পাকিস্তানকে ১০ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবার টেস্ট জয়ের স্বাদ পেল। যে জয় নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক স্মারক হয়ে থাকবে, যে জয় তাদের প্রাপ্য। টেস্ট ক্রিকেটে এতো বড় জয় আর যে নেই বাংলাদেশের।
পাঁচ দিনে কী দাপটে খেলেছে বাংলাদেশ! শেষ দিনে আরও দুর্ধর্ষ। পাকিস্তানের ৯ উইকেট মাত্র ১২৩ রানে গুটিয়ে দিয়ে চা বিরতির আগেই ৩০ রানের লক্ষ্য পায় বাংলাদেশ। জাকির-সাদমানের অবিচ্ছন্ন উদ্বোধনী জুটি বাংলাদেশকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের বন্দরে। যে বন্দরে নোঙর ফেলতে ২৩ বছর সময় নিলো বাংলাদেশ।
দেশের বাইরে যা বাংলাদেশের সপ্তম টেস্ট জয়। আগের পাঁচটির দুটি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েতে। একটি করে শ্রীলঙ্কা ও নিউ জিল্যান্ডে। সবশেষ ছিল মাউন্ট মঙ্গানুইতে। এবারের জয় নিশ্চিতভাবেই আলাদা গুরুত্ব পাবে। কেননা এই ম্যাচের আগেই বাংলাদেশের অধিনায়ক শান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘রেকর্ড পরিবর্তন করা যায়।’ পাঁচদিনের লড়াই শেষে পরাজয়ের বৃত্ত ভেঙে রেকর্ড পরিবর্তন করেই ছাড়লো লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
প্রথম যেকোনো কিছুই আনন্দের। গর্বের। ঐশ্বর্যের। পাকিস্তানের মাটিতে ১০ উইকেটের জয়ও তেমন কিছু। পাকিস্তান নিজেদের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথমবার ঘরের মাঠে ১০ উইকেটে হারলো। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড কত দলই তো পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলেছে। সবকটি উইকেট হাতে রেখে জয়ের অভিজ্ঞতা নেই কারও। বাংলাদেশ তা পেল চোখের পলকে।
জয়ের ভিত গড়া হয়ে যায় প্রথম সেশনেই। পাঁচ উইকেট নিয়ে বোলাররা দুই সেশন আগে জয়ের সুবাতাস ছড়িয়ে দেন চারপাশে। যে বাতাস পিন্ডি ছাড়িয়ে ২ হাজার ১২ কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশে মিশে যায়। আগের দিন সাইম আইয়ুবের উইকেট পেয়েছিলেন পেসার শরিফুল ইসলাম। আরেক পেসার হাসান মাহমুদ ভোগাচ্ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক শান মাসুদকে।
রোববার পঞ্চম দিনের সকালে তার উইকেট নিয়েই সাফল্যের পথে পা বাড়ানো শুরু বাংলাদেশের। হাসানের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। বাংলাদেশের সামনে বাবর আজম দেয়াল হয়ে দাঁড়ালে বিপদ! তাকে ফেরাতে শান্ত দ্রুতময় বোলার নাহিদ রানাকে বোলিংয়ে আনেন। তাতে কাজ হয়ে যায়। ফুলার লেন্থ বল জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটে টেনে আনেন বাবর।
এরপর শুরু হয় সাকিব ও মিরাজের ম্যাজিক। তাদের স্পিন বিষে স্রেফ নীল পাকিস্তান। বাঁহাতি স্পিনার সাকিবের বল ডাউন দ্য উইকেটে এসে উড়াতে গিয়ে স্টাম্পড হন সৌদ শাকিল। ওপেনার আব্দুল্লাহ শফিক সাকিবের টার্নের বিপরীতে খেলতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ দেন। উইকেটের জোয়ারে মিরাজ সুযোগ বুঝে আর্মার ডেলিভারিতে স্লিপে তালুবন্দি করান আগা সালমনাকে। ৬৬ থেকে ১০৫ রানে যেতে মিডল অর্ডারে ৪ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান পরাজয়ের কাছাকাছি চলে যায়।
মধ্যাহ্ন বিরতির আগে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৯ রানে পিছিয়ে ছিল। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ১১৭ রানের লিড পেয়েছিল। জয় আস্তে আস্তে উঁকি দেওয়া শুরু করেছিল। শুধু ভয় ছিল মোহাম্মদ রিজওয়ানকে নিয়ে। ২০০৩ সালে এমনই হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ ইনজামাম উল হক একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন। খালেদ মাহমুদ সুজন চোখের জল মুছে স্টেডিয়াম ছেড়েছিলেন। সেই দুঃস্মৃতি এবার আর ফিরল না। ফিফটির পর মিরাজের বল সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হন রিজওয়ান।
এর আগে মিরাজের শিকার হন শাহীন শাহ আফ্রিদি। সাকিব তুলে নেন নাসিম শাহর উইকেট। পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন মিরাজ। এলবিডব্লিউ করে ফেরান মোহাম্মদ আলীকে।
পঞ্চম দিনের প্রথম ঘণ্টার পর থেকে উইকেট থেকে টার্ন ও বাউন্স আদায় করতে থাকেন সাকিব ও মিরাজ। অভিজ্ঞতায় তারা পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করেন। পিন্ডির উইকেট নিয়ে শুরু থেকে চর্চা হচ্ছিল। পেস বোলারদের জন্য বাড়তি সুবিধা থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট পেস ও স্পিনে ভারসাম্য আক্রমণ রেখে পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। তাতে মিলেছে সুফল।
৩০ রানের লক্ষ্য তাড়ায় জাকির বা সাদমান কেউই তাড়াহুড়া করেননি। সহজাত ব্যাটিংয়ে সহজেই পৌঁছেছেন জয়ের বন্দরে। জাকিরের চার যখন সীমানা পেরিয়ে যায় তখন স্টেডিয়ামের স্পিকারে গান বাজতে থাকে, ‘দোলা দে রে পাগলা দোলা দে রে।’ নাজমুল হোসেন শান্তর দল দোলাটা দিয়েই দিল। এই জয়, এই বীরত্বগাঁথা, এই সাফল্যসূর্য নিশ্চিতভাবেই আলোকিত করে তুলবে বাংলাদেশের টেস্ট আকাশ।