সাক্ষাৎকার

‘সেন্সর, অনুদান, পুরস্কার এক অর্থে পশু বিশেষজ্ঞদের হাতে’

কামার আহমাদ সাইমনের চলচ্চিত্র 'শিকলবাহা' এ বছর জুনে প্রিমিয়ার হয়েছে সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসবের গোল্ডেন গবলেট মূল প্রতিযোগিতায়। এর আগে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড’ এবং বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান পেয়েছিল এই ছবির চিত্রনাট্য। ইডফার মূল প্রতিযোগিতায় ছিল কামারের হাইব্রিড ছবি ‘অন্যদিন...’। এ জন্য লোকার্নোর পিয়াতজা গ্রান্দাতে পুরস্কৃত হন তিনি। কামারের নন-ফিকশন ছবি ‘শুনতে কি পাও!’ ইউরোপের অন্যতম উৎসব সিনেমা দ্যু রিল থেকে পেয়েছিল সেরা ছবির পুরস্কার গ্রা প্রি এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সম্প্রতি তার সঙ্গে দেশের সেন্সর বোর্ড এবং জাতীয় চলচ্চিত্রের অনুদান-নীতিমালা প্রসঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ নির্মাতা অনার্য মুর্শিদ

রাইজিংবিডি: চলচ্চিত্র নীতিমালা ২০১৭ এর ৫ নাম্বার পয়েন্ট হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা এবং অসত্য তথ্য পরিবেশন না করা। ২০২৩-এর চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনেও এ কথা বলা আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সত্য-অসত্য কীভাবে আমরা জাস্টিফাই করব?

কামার আহমাদ সাইমন: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের প্রজন্মের কাছে খুবই ঘোলাটে ব্যাপার। শুনতে সুন্দর শোনায় এ রকম কতগুলা পলিটিক্যাল রেটরিকের বাইরে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র প্রয়োগ আমরা দেখি নাই। গত পঞ্চাশ বছরে একটা করে দল এসেছে, আর একবার করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সংজ্ঞা রিভাইজ করেছে। তারপর একদল ‘দলকানা’র সাথে ধান্দাবাজ কিছু ‘চেতনাজীবী’ বা ‘চেতনা-ব্যবসায়ী’ উৎপাদন করা হয়েছে, যারা আবার এই রিভাইজড চেতনার উৎপাদন-পুনঃউৎপাদন (রিপ্রডিউস) করে গেছে। ফলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র পলিটিক্যাল ইকোনোমি তৈরি হয়েছে, যেটা আবার সংস্কৃতির আর পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতেও আছর করেছে। 

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ঘিরে কালচারাল পলিটিক্সের মৌলিক প্রস্তাবনা যেমন— আইনের শাসন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার, ইত্যাদি গত ১৬ বছর অপমান করেছেন ক্ষমতাসীনেরা। চেতনার নামে সাধারণ মানুষের আদারিং (অপরায়ন) এমনভাবে করা হয়েছে, এরপর ‘চেতনা’ শব্দটিতেই মানুষের এলার্জি শুরু হলো। ফলে মানুষ যখন গান-বাজনা-কবিতা বা সিনেমায় এই চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেছে, তখন বেনিফিসিয়ারি গ্রুপকে তাদের ‘চেতনা-ডকট্রিন’ রক্ষা করার জন্য আইন করতে হয়েছে। সেখান থেকেই শুরু এই চেতনা ‘সমুন্নত রাখা’ বা এর ‘সত্য-অসত্য’র প্রশ্ন। চলচ্চিত্র নীতিমালায় এই ডকট্রিনটাই কপি-পেস্ট করেছেন আমলারা তাদের নিজেদের লেজুড়বৃত্তি আর চৌর্যবৃত্তি জারি রাখার জন্য।

আশির দশকে পশ্চিমা নিউ-লিবারাল যুগ শুরু হওয়ার আগে, সত্তরের দশক একটা ক্রিটিক্যাল সময়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সারা পৃথিবীতে একটা ঘৃণিত নাম, পশ্চিম আর সোভিয়েত আধিপত্যবাদের মধ্যে শীতল যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় ইন্টারভেনশনের একটা জিও-পলিটিক্যাল সুযোগ তৈরি হয়েছিল। প্রেক্ষাপট তো ১৯৪৭ সাল থেকেই তৈরি ছিল। কিন্তু এর বাইরে জনপরিসরে এই একাত্তরে যুদ্ধের দুটি ক্রিটিক্যাল অ্যাঙ্গেল আছে। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বাম আন্দোলন থেকে তৈরি হওয়া স্বাধীনতাকামী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর অন্যদিকে নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর যুদ্ধে মরিয়া মুক্তিকামী কৃষক— সমাজের দুই মেরুতে থাকা স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দুই নায়কের এক জায়গায় চলে আসা এবং তৎপরবর্তী সময়ে আবার প্রতারিত হওয়া, এর একটা ক্লাসিক চরিত্র আছে।

এই চরিত্রের কারণেই দিল্লীর সালতানাতরা এই জনপদের নাম দিয়েছিল ‘বুলগাকপুর’ (বিদ্রোহের শহর)। অত দূর যদি নাও যেতে চান, অন্তত দুইশ বছর আগে থেকে শুরু করতে হবে— ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চরিত্র বুঝতে গেলে ন্যূনতম ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করতে হবে। অথচ চেতনাজীবীদের চাপে আমরা ১৯৫২-এর আগে ভাবতেই পারি না। এখন ১৯৪৭-কে পড়ি ‘দেশভাগ’ হিসাবে। কিন্তু তখনকার প্রত্যেকটা আলাপে ৪৭-এর মানে পাবেন ‘স্বাধীনতা’। সেই বিচারে ২০২৩-এর চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংক্রান্ত আলাপ এই অর্বাচীন বা স্টুপিড যাত্রারই ফসল। একাডেমিক চর্চা বা রিসার্চের কথা বাদ দেন; একটা স্বাধীন দেশে আইনের কারণে মানুষ যদি তার নিজের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনযুদ্ধের ইতিহাস বা অধ্যায় নিয়ে জনপরিসরে চর্চা করতে না পারে, তাহলে সাধারণে সেই যুদ্ধ তার রেলিভেন্স হারাতে বাধ্য। 

রাইজিংবিডি: নীতিমালার ৬ নাম্বার পয়েন্টে বলা হয়েছে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনে জনসাধরণকে উৎসাহিত করতে হবে। অপরদিকে আপনি যদি কোনো দুর্নীতিবাজকে স্যাটেয়ার করে একটি চলচ্চিত্র বানান তাহলে সে সাইবার অ্যাক্টে মামলা করতে পারে। দেখা গেল চলচ্চিত্র সেন্সরশিপমুক্ত হলেও চলচ্চিত্র পরিচালক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই কন্ট্রিডাক্টরিকে আপনি তখন কীভাবে দেখবেন?

কামার আহমাদ সাইমন: এই নীতিমালা তো মানুষের চোখে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া কিছু না। বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড একটা অনির্বাচিত সরকারের ১৬ বছরের দুঃশাসনে গড়ে ওঠা পাঁচটা চাটুকার-স্ট্যাম্পমারা প্রতিষ্ঠানের মতোই আরেকটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। পদাধিকার বলে আমলারা চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সকল প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা। এর সদস্যরা সরকারের উচ্ছিষ্টলোভী কিছু কাজকাম নাই টাইপের শিল্পী।  এখানে তারা আসেন মূলত হাত-খরচ আর টাইম-পাসের জন্য। এ রকম একটা বন্দোবস্তে বানানো প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা হিপোক্রেটিক হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই! 

রাইজিংবিডি: নীতিমালায় প্রমিত ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সংলাপে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গ এসেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে বর্তমানে ভাষা দ্রুত গতিতে বদলাচ্ছে। এ মুহূর্তে এগুলোর মানদণ্ড আমরা কীভাবে ঠিক করব?

কামার আহমাদ সাইমন: এই প্রশ্নের দুইটা দিক একটু আলাদাভাবে বুঝতে হবে। প্রথমত মানদণ্ড জিনিসটাই কোয়ার্সিভ— সাংস্কৃতিক রাজনীতির একটা স্বৈরাচারী টুলস। আর আপনি যেটাকে বিশ্বায়ন বলছেন, সেটা আসলে একুশ শতকের কলোনাইজেশন। যেখানে ভাষা হলো অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র বা ফ্রন্টলাইন। এই দুটো হিসাব বুঝে নিলে, আপনি দেখবেন লড়াইটা ঘরে-বাইরে, দুইদিকে চলছে। একদিকে আপনি হলিউড, বলিউড, টালিউড, তামিল, তেলেগু চলচ্চিত্র বাজারের খদ্দের, আরেকদিকে আপনি নিজ দেশেই চেতনা আর মানদণ্ডের প্রশ্নে আটকানো। 

সিনেমার বাইরের একটা উদাহরণ দেই, বুঝতে সহজ হবে। আপনি যদি ২০২৪ সালের নতুন বাংলাদেশে দেয়ালচিত্র-গ্রাফিতিগুলার দিকে তাকান, দেখবেন এরা এক অর্থে হয়তো গ্লোবালাইজড। এদের কন্টেন্টে দেশি-বিদেশি অনেক রেফারেন্স পাবেন। কিন্তু তবুও এদের এস্থেটিকস সেন্স অনেক মানুষের অনেক কাছাকাছি। এদের লাইন-ড্রইং, রঙের ব্যবহার, ক্যালিগ্রাফি— সব জায়গায় মাটির একটা গন্ধ পাওয়া যায়। যেটা গত দুই দশকের প্রতিষ্ঠিত সব শিল্পী বা আর্টিস্টদের ক্যানভাসকে খারিজ করে দিয়েছে। চারুকলার প্রতিষ্ঠিত সমস্ত গ্রামার ভেঙে দিয়েছে, এক্সক্লুসিভ শিল্পচর্চাকে এক্সিবিশন গ্যালারীর বাইরে নিয়ে এসেছে।

আজকে একদিকে হাতে গোনা কয়েকটা নামজাদা গ্যালারীর এক্সিবিশনে না গিয়ে ছাত্ররা রাস্তায় রাস্তায় ছবি আঁকছে। আরেকদিকে নাক-উঁচু গ্যালারী স্যোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত কার্টুন বা ব্যাঙ্গচিত্রের প্রদর্শনী করছে। অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেন নাই, কিন্তু যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাঁরা জানেন, বিশ্বের শিল্পচর্চার ভাষায় এই পরিবর্তন তো অন্তত কয়েক দশক ধরেই চলছে। প্যারিসে, লন্ডনে, নিউইয়র্কে, আমস্টারডামে, স্টকহোমে— দুনিয়ার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরেই এই ট্রেন্ড দেখেছি। দুনিয়াব্যাপী মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের (MoMA) কনসেপ্টই এই। ২০২২ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মুভিং ইমেজে (MoMI) ‘অন্যদিন...’-এর আমন্ত্রণ ছিল। সে বছর ওরা মাত্র ১৮টা ছবি ফিচার নির্বাচিত করেছিল, যেগুলো নিয়ে আয়োজকরা লিখেছিলেন— সেইসব ছবি যারা সিনেমার পরিচিত ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে। এখন আজকের সময়ের এই নতুন ভাষা আমাদের সিনেমা যদি পড়তে না পারে, তাহলে সেটা হবে আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য দূর্ভাগ্যের। নীতিমালার নামে একে যারা মানদণ্ড আর প্রমিত ভাষার কারাগারে বন্দী করে রাখবেন, ভবিষ্যতে এর মৃত্যুর জন্যও তারা দায়ী থাকবেন।

রাইজিংবিডি: কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সাক্ষাৎকারে আপনিও চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপ বাতিল চেয়েছেন। আপানারা এর পরিবর্তে সার্টিফিকেশন আইন চেয়েছেন। গত বছরই তো এটা বাতিল হয়ে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশান আইন হয়েছে। তাহলে কেনো আপনারা আবার সেন্সর প্রথার কথা বলছেন?

কামার আহমাদ সাইমন: আমি কিন্তু সেন্সরশিপ বাতিল করে সার্টিফিকেশন আইনের দাবি করি নাই। আমি প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেন্সর বোর্ডের লিগেসি এবং প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তদের অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছি। যেহেতু ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতবর্ষের মানুষের মুখ বন্ধ রাখার জন্যই এটা করা হয়েছিল। তখন এই আইনের নাম ছিল ‘সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট’। এরপর আইনটা প্রথমে পাকিস্তান, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন নতুন নামে হাজির হয়েছে মাত্র। কিন্তু এর মৌলিক প্রস্তাবনা বদলায়নি। সেন্সর বোর্ড হলো সেই কলোনিয়াল লিগ্যাসির গার্ডিয়ান, কতগুলো বাতিল শিল্পী আর আমলাদের মাস্তানির জায়গা। শিল্প, সাহিত্য আর সিনেমার মাধ্যমে মানুষের যৌথ প্রকাশ তো সমাজের মৌলিক অধিকার—একটি স্বাধীন দেশে তো সেন্সর বোর্ড বলে কিছু থাকার কথাই ছিল না।

আমি শুধু আইন না, সেন্সর বোর্ড বলেই কিছু দেখতে চাই না বলেছিলাম। শুধু ছবির রেটিং আইন না, যে কোনো প্রকার আমলামুক্ত নতুন একটা রেটিং বোর্ডের কথা বলেছিলাম। যেহেতু নতুন নামে (সেন্সর রেটিং) আইন হলেও ভিতরে কথা আর সুর প্রায় একই আছে, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সেই পুরানো আমলাতন্ত্র। আমি তাই বলেছিলাম, পশু-বিশেষজ্ঞ যেমন বাগান করার পরামর্শ দিতে পারেন না, তেমনি সিনেমা নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া আমলাদের কাজ না। এই ভয়াবহ অন্যায়টা আমি বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে চাই। ২০২৪-এ দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর এই অন্যায় আর চলতে দেওয়া যায় না। সেন্সর রেটিং বোর্ড এবং এ সংক্রান্ত যে কোনো আইন, সামনের বছরগুলাতে জাতীয় সিনেমার চেহারা ঠিক করবে। তাই সেখানে এমন মানুষদের বসানো দরকার যারা শুধু সিনেমার হালহকিকতই না, সেই সঙ্গে তাবৎ দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য এবং নিজের চলতি সমাজের পালস বোঝেন। আর কোনো ছবি নিয়ে আপত্তি থাকলে সেটার ওপেন পাবলিক হিয়ারিং ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন আদালতে হয়। জবাবদিহিতা না থাকলে যতই নতুন নতুন বোর্ড বানাই আর গণতান্ত্রিক আইন করি না কেন দিন শেষে ক্ষমতা মানুষকে সাইকোপ্যাথ বানায়। গত দশ বছরের অভিজ্ঞতায় এটা সবচেয়ে বড় প্রমাণিত সত্য। 

রাইজিংবিডি: চলচ্চিত্রের অনুদানের যে নীতিমালা বর্তমানে আছে সেটা কি ঠিক আছে? ঠিক না থাকলে নতুন নীতিমালা কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

কামার আহমাদ সাইমন: সেন্সর বোর্ডের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সরকারী অনুদান— পুরো সিস্টেম বাতিল এবং পুরানো সেই আমলা নির্ভর একটা করাপ্ট ব্যবস্থা। আমাদের ‘শুনতে কি পাও!’ সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার এবং ‘শিকলবাহা’ সিনেমায় অনুদান পাওয়ার সূত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে কথাটা বলছি। গত ১৬ বছরে কারা পুরস্কার পেয়েছেন, কারা অনুদান পেয়ে ছবি বানিয়েছেন সেই তালিকায় একবার চোখ বুলালেই বুঝতে পারবেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে জাতীয় পুরস্কার বা সরকারি অনুদান মন্ত্রী-আমলারা বসে সিদ্ধান্ত নেন কিনা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশে নেন। এটা ঠিক করাটা খুব কঠিন কাজ না। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই চলচ্চিত্রে অনুদানের ব্যবস্থা আছে, যেখানে শিল্প-সংস্কৃতি সংক্রান্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান অনুদানের নানান কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানে যে কোনো প্রকার দুর্নীতি হয় না, তা কিন্তু না, সেখানেও দুর্নীতি আছে। কিন্তু গোটা অনুদান ব্যাপারটা যেহেতু সরকারি ব্যবস্থার বাইরে, তাই এর সফলতা বা ব্যর্থতা দুইটাই সেই স্বাধীন সংগঠনগুলার দায়। জার্মানী থেকে ‘শিকলবাহা’র জন্য আমরা যে প্রতিযোগিতামূলক অনুদান পুরস্কার পেয়েছিলাম সেটা ছিল ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড’ (WCF) নামের একটা বিশ্বনন্দিত প্রোগ্রাম থেকে। এই প্রোগ্রামটা বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের একটা এইস প্রোগ্রাম, যার সাপোর্ট দেয় গ্যোথে ইন্সটিটিউট। আবার ইন্সটিটিউটকে টাকাটা দেয় জার্মানীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ক্রিয়েটিভ ইউরোপ মিডিয়া প্রোগ্রাম। তিনটা হাত ঘুরে আসে বলে এবং বার্লিনের মতো একটা ক্রিটিক্যাল উৎসবের এইস প্রোগ্রাম হিসাবে এর অনেক পাবলিক এক্সপোজার থাকে। ফলে সরকারিভাবে এখানে প্রভাব খাটানোর আর সুযোগ থাকে না। 

তাই সেন্সর সিস্টেমের মতো জাতীয় পুরস্কার, সরকারি অনুদানসহ সিনেমার পুরা সিস্টেমটা বিলুপ্ত করে একটা স্বাধীন সাংস্কৃতিক সংগঠন, মিউজিয়াম বা উৎসবকে যৌথভাবে টাকাটা দেওয়া যেতে পারে। সেখানেও যে দুর্নীতি হবে না তা না, কিন্তু যৌথভাবে একাধিক সংগঠনকে দায়বদ্ধ করতে পারলে এবং পাবলিক পিচিঙের ভিতর দিয়ে কয়েক হাত ঘুরে আসলে দুর্নীতির সম্ভাবনা কমে। এখানে যৌথ সংগঠন এবং পাবলিক পিচিঙে এক্সপোজারটা গুরুত্বপূর্ণ কেন? একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। গত অনেক বছর ধরে শিল্পকলা একাডেমীতে অনেকেই সিস্টেমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিল্প-চর্চা, সিনেমা আন্দোলন করেছেন। কেউ কেউ তো শুনলাম শিল্পকলার রুমগুলাকে প্রায় ব্যক্তিগত অফিস হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এদের অনেকেই ইদানীং অনেক বিপ্লবী কথা বলছেন। কিন্তু সিস্টেমের কোলে বসে যে সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না এটা তো এনারা সবাই জানতেন, তারপরেও করেছেন। এ কারণেই যৌথতা এবং পাবলিক এক্সপোজার দরকার যে কোন অনুদান সিস্টেমে। যেহেতু শ্রুতিচিত্র এখনো অত্যন্ত শক্তিশালী একটা মাধ্যম। এর রিস্ক এবং সম্ভাবনা এই অস্থির সময়েও খুব ভ্যালিড— সেটা সিনেমা বা কন্টেন্ট, যে নামেই ডাকি না কেন।