মাদকের মিথ্যা মামলায় জেরবার হয়ে গেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি পরিবার। পুলিশ ও প্রভাবশালীদের ভয়ে এতদিন পরিবারটি মুখ খোলার সাহস করেনি। বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবারটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সঙ্গে করা অন্যায়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। সুষ্ঠু তদন্ত করে শাস্তি দাবি করেছেন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কয়েকজন অসাধু সদস্যসহ এ ঘটনার নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তির।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানান রুবিনা বেগম। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মহিষালবাড়ি এলাকায় তার বাড়ি। রুবিনার দাবি, জেলা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ইনামুল ইসলাম তার স্বামী এজাজুল হক, দেবর নাহিদ হক ও চাচা শ্বশুর জহুরুল ইসলামকে পরপর তিনটি মিথ্যা মাদকের মামলায় ফাঁসিয়েছেন। এরমধ্যে জহুরুলের মামলাটি আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অন্য দুটি মামলা এখনও চলমান। রুবিনার স্বামী এজাজুল হক এখনও কারাগারে রয়েছেন।
রুবিনা জানান, তার স্বামী এজাজুল পাওনা টাকা নিতে গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর আদালতপাড়ায় আসেন। তখন ডিবির এসআই ইনামুল ইসলাম আদালতপাড়া থেকে এজাজুলকে তুলে নিয়ে যান। এরপর রাতে তাকে গোদাগাড়ী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় তার নামে মাদক আইনে মামলা করেন এসআই ইনামুল। মামলার এজাহারে বলা হয়, গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ক্যানেলপাড়া গ্রামের এক কলাবাগান থেকে রাত আড়াইটার সময় এজাজুলকে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ এজাজুল আগের রাতে মাটিকাটা এলাকায় যাননি। তার মোবাইলের নেটওয়ার্ক চেক করলেই বিষয়টি জানা যাবে। আদালতের সামনে থেকে দুপুরে তাকে তুলে নেওয়া হয়। রুবিনা দাবি করেন, মেডি নামের এক ধরনের নকল হেরোইন দিয়ে এজাজুলকে জেলে পাঠানো হয়। তিনি এখনও জেলে আছেন।
রুবিনা জানান, তার পরিবারের সদস্যদের ফাঁসানোর পেছনে গোদাগাড়ী পৌরসভার সদ্য সাবেক কাউন্সিলর মনিরুল ইসলামেরও হাত রয়েছে। তিনি ডিবির এসআই ইনামুলকে হাত করে তার দেবর ও চাচা শ্বশুরকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়েছিলেন। মনিরুলের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে জমিসংক্রান্ত বিরোধের কারণে তাদের ফাঁসান মনিরুল।
রুবিনা জানান, গত বছরের ২৩ অক্টোবর এসআই ইনামুলসহ কয়েকজন মহিষালবাড়ি বাজারে তার দেবর নাহিদ হকের দোকানে যান। এরপর দোকান থেকে নাহিদ, তার কর্মচারী শাহীন ওরফে নূর এবং তার আত্মীয় মতিউর রহমান মোতালেবকে তুলে নিয়ে যান। পরে ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন এসআই ইনামুল। টাকা নেওয়ার পর রাতে থানায় মামলা দেন যে, রাত ১টার দিকে মহিষালবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে হেরোইনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ সেদিন তিনজনকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর আসামিরা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন।
রুবিনা বলেন, ‘২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি এসআই ইনামুল ইসলাম প্রথম আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করতে শুরু করেন। সেদিন আমার চাচা শ্বশুর জহুরুল ইসলামকে মহিষালবাড়ি এলাকার নিজ বাড়ির দরজার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যান এসআই ইনামুল। এছাড়া সেদিনই নিজ দোকান থেকে তুলে নেওয়া হয় আমার দেবর নাহিদ হককে। তারপর হেরোইন উদ্ধার দেখিয়ে থানায় মামলা করা হয়। মামলায় আরও দুজনকে পলাতক আসামি দেখানো হয়। পরে গত বছরের ২২ নভেম্বর রাজশাহীর জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে আদালত মামলার সকল আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। এতে প্রমাণ হয়, যে এসআই ইনামুল ইসলাম আমাদের পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিচ্ছেন।’
রুবিনা বলেন, ‘আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি মামলার বাদীই ডিবির এসআই ইনামুল ইসলাম। তিনি কথিত অভিযান চালিয়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়েছিলেন। তারপর মাদকবিরোধী অভিযান হিসেবে দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে প্রতিটি অভিযানেই ছিলেন কনস্টেবল শাহাদত জামান, মেশকাত হোসাইন ও আসলাম হোসাইন। এই পুলিশ সদস্যদের নিয়ে এসআই ইনামুল ইসলাম একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন। তারা যাকে খুশি তুলে এনে টাকা আদায় করতেন এবং প্ররোচিত হয়ে মামলা দিতেন।’
রুবিনা বলেন, ‘মাদক মামলার পেছনে থাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর মনিরুল ইসলামও শীর্ষ মাদক কারবারি। এই মনিরুল আমার স্বামীর খালা সখিনা খাতুনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর মহিষালবাড়ি বাজারে সখিনার একটি পৈতৃক জমিতে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়নি বলে আমার স্বামী, দেবর ও তাদের চাচা জহুরুল ইসলাম বাধা দেন। এর ফলে ওই মার্কেট নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের কারণে মনির ওই জমিতে মার্কেট করতে পারছেন না। তাই বার বার তিনি মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠিয়ে জায়গাটি দখলের অপচেষ্টা করেছেন।’
ডিবিকে হাত করে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক কাউন্সিলর মনিরুল ইসলামকে ফোন করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। ডিবির এসআই ইনামুল ইসলাম বলেন, কোন মামলাগুলোর বিষয়ে বলা হচ্ছে তা তিনি মনে করতে পারছেন না। এজাহার না দেখে বলতে পারবেন না।
তার দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি কথা বলবেন না।