ঐতিহাসিকভাবে এ বঙ্গ অঞ্চলের মানচিত্র পরিবর্তন হয়েছে বারবার। তৎকালীন মোঘল শাসকরা দিল্লি থেকে যতবারই বঙ্গ জনপদ শাসন করেছেন, ততবারই এ অঞ্চলের মানচিত্র পরিবর্তন হয়েছে। মোঘল আমলের সর্বশেষ সংস্করণ হলো নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে বাংলা (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও আসামের কিছু অংশ), বিহার ও উড়িষ্যা মিলিয়ে ছিল বঙ্গ অঞ্চল।
তারপর ইংরেজরা বাঙলার এই মানচিত্র পরিবর্তন করেছে একাধিকবার। এখানে বলে রাখা ভালো, মোঘল শাসকরা বা ইংরেজরা যখন যা করেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের নিজেদের শাসনের স্বার্থে বা সুবিধায় করেছে।
এরপর এই অঞ্চলের মানচিত্র আরেকবার পরিবর্তন হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের সময়। বাংলা অঞ্চল ভাগ হয়ে পূর্ব অংশটা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান, আরেকটা অংশ ভারতের একাধিক প্রদেশে গেছে (পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরার একটা অংশ)। ১৯৭১ সালে এসে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ।
মোঘল শাসনামল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলকে যতবারই ভাগ করা হয়েছে, মানচিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে। তারপরেও বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ লালন করে এসেছে। এখন পর্যন্ত ভারতের কয়েকটি প্রদেশে থাকা বঙ্গ অঞ্চল এবং পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশ) অনেক মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে এবং লালন করে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল তণমূল কংগ্রেসও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা ও আসামের অধিকাংশ বাঙালিরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে।
এ দিকে স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই গ্রহণ করা হয়। তবে ভারতীয় বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোনোটাতেই কিন্তু দুই দেশের বঙ্গ অঞ্চলগুলো আবার একত্রিত হয়ে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা হবে- সরাসরি এ রকম আলোচনা করা হয় না। নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় এটি হওয়া অসম্ভবও বটে।
অখণ্ড বাংলার আলোচনা না হলেও মানচিত্রে ভাগ হওয়া এ বঙ্গ অঞ্চলগুলোর মধ্যে ভালোবাসা, সুসম্পর্ক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কথা বলা হয়। যা পরিবর্তিত বিশ্বে বাঙালিদের একতা বা ঐক্য হিসেবে সামনে আসতে পারে, সেটা হোক ভৌগোলিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক।
এর বিপরীতে ভারতের বিজেপি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছাপিয়ে অখণ্ড ভারত তত্ব সামনে রাখার চেষ্টা করে। আর বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বলা হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আধুনিক পুরো বাঙলা অঞ্চল নয়; বরং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদলে বাঙলা অঞ্চলের পূর্ব অংশের (স্বাধীন বাংলাদেশ) জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে।
এরপর আসি জাতীয় সংগীতের বিষয়ে। আমাদের জাতীয় সংগীতটি রচনা করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে। বৃটিশ কর্তৃক আরেক দফা বাঙলা অঞ্চল ভাগ করার প্রেক্ষাপটে। আগেই বলেছি, বঙ্গ অঞ্চলের বারবার মানচিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাও বহমান ছিল যুগ যুগ ধরেই। এই সংগীত রচনা করার পর বাঙলা অঞ্চলের মানচিত্র একাধিকবার পরিবর্তন হলেও পূ্র্বের মতই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে আছে অসংখ্য মানুষ।
আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা অঞ্চলের পূর্ব অংশে (স্বাধীন বাংলাদেশ) বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ভারত অংশে অখণ্ড ভারত তত্বও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ দুই জাতীয়তাবাদের মতানৈক্য সামনে আসে বারবার। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থকরা দাবি তুলছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে লেখা জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে লেখা কোনো গানকে জাতীয় সংগীত করা হোক, যেখানে বাংলাদেশ শব্দটি উল্লেখ আছে।
তবে বিএনপি, জামায়াত কিংবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক দল অফিসিয়ালি এ রকম দাবি করেছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখেও শুনিনি কখনো। অথচ ইদানীং দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটা অংশ অবশ্য ভালোই প্রচারণা চালাচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়