মতামত

শূন্যের ভেতরে দেখি সম্ভাবনার বাংলাদেশ

নতুন আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সেই আকাঙ্ক্ষার নাম বৈষম্যমুক্ত হওয়া, গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ জারি রাখা, ভোটাধিকারের সুযোগ পাওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জন এবং মানবাধিকারের সূচকগুলোকে সদর্থক অর্থেই বাস্তবায়ন করা। বিষয়গুলো কঠিন, তবে অসম্ভব নয় মোটেই। কিন্তু যারাই ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেছেন এগুলো বাস্তবায়ন না করে, উল্টো অধরা-অসম্ভব করে তুলেছেন। আরোপিত এক শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছেন, যার নাম স্বৈরতন্ত্র।

পাকিস্তানের ২৪ বছর আমাদের লড়াই ছিল এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। বেদনার হলো, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির বিজয় অর্জন করলেও; ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মেলেনি, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বাস্তব সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরে দুটো গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। দেশবাসীর জন্য আরও বেদনার ও গভীর দুঃখের বিষয় হলো, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মুক্তির পথ নিশ্চিত করা যায়নি। উপরন্তু গত ১৫ বছর ধরে দেশবাসীকে দেখতে হয়েছে এক স্বৈরাচারী সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা। এই বাস্তবতায় গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। যার বিজয় অর্জিত হয় ৫ আগস্ট। অভূতপূর্ব সেই অর্জনের আজ মাসপূর্তি। এ উপলক্ষে ফিরে দেখা এই অর্জনের যারা নায়ক সেই ‘জেন জি’ প্রজন্মকে।

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার এই ‘জেন জি’ প্রজন্মকে আমরা বলছি ‘শূন্য প্রজন্ম’। কেন তার সওয়াল রয়েছে এই লেখায়। শূন্যকে আদৌ চিনি কি আমরা? শূন্যের ভেতরে এত ইতিহাস আছে, সে কথা কি জানতাম, নাকি জানার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের? ‘শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথের যে আকাঙ্ক্ষা, ‘শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই’ সেটাই বা কতটুকু ধারণ করা হয়েছে সবার মর্মে মর্মে? ‘যদি’, ‘কিন্তু’র আশ্রয়ে; বিতর্কের অভিপ্রায়ে বলা যেতে পারে অনেক কথা। বাস্তবতা ও রূঢ় সত্য হলো ধারণ করিনি, করতে পারিনি। 

আমরা করিনি বলে যে অন্যরা ধারণ করবে না, তা তো নয়। ‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে/ কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।’ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের শূন্যরে পূর্ণ করার ব্রত পালনের প্রত্যয় হাজির করেছে নতুন প্রজন্ম। যে প্রজন্মকে বিদ্যায়তনিক পরিভাষায় বলা হচ্ছে ‘জেড প্রজন্ম’। এই লেখা তাদের নিয়েই। আমরা যাকে বলতে চাই ‘শূন্য প্রজন্ম’। কবিতায় যে প্রজন্ম হাজির হয়েছে এভাবে ‘শূন্যের ভেতর যত ঝনঝনানি, যত নীরবতা, যত কোলাহল/ সব চেপে বুকে শূন্য প্রজন্ম মুছে, বাংলা মায়ের চোখের জল/... শূন্যের ভেতরে এত ইতিহাস, এত প্রত্যয়, বুক ভরে আছে তার সংরাগে/ বুঝিনিকো তার কিছু, জানিনি তো শূন্য ২০২৪, আবু সাঈদকে দেখার আগে।’ অভূতপূর্ব এক ঘটনার জন্ম দিলো বাংলাদেশ, এই ২০২৪-এ। ইতিহাসে যার পোশাকি নাম হবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। চিহ্নায়ক হিসেবে সংখ্যা সবার কাছে মান্যতা পেয়েছে বলে এভাবেই ভাবা হয়, যার নজির দেখা যায় সাম্প্রতিক অতীতে। যদিও শতাব্দীর ব্যবধান ঘুঁচে গেলে এবং তাতে কয়েক শতাব্দীর মরচে পড়লে সন-তারিখের গুরুত্ব কমে আসে। তখন স্বীকৃতি দেওয়া হয় ব্যক্তির নাম বা ঘটনাপ্রবাহের গুরুত্ব, যেখান থেকে চয়ন করা হয় তার মূল শক্তি ও মর্মার্থ। এর পেছনেও হয়তো শাসনকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঘুণপোকা রয়েছে, এ ক্ষেত্রে কাজ করে তারই আছর ও অভীপ্সা। 

এ কারণে আমরা মনে করি, এই অভ্যুত্থান প্রথম থেকেই সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন সন চিহ্নায়কের বাইরে গিয়ে, মর্মার্থের আলোকে এবং তার নৈতিক শক্তির ভিত্তিতে। এ অভ্যুত্থানে যেহেতু নেতৃত্ব দিয়েছে ‘জেড প্রজন্ম’ আমরা যাকে বলছি শূন্য প্রজন্ম। সুতরাং এর নাম হওয়া উচিত শূন্য প্রজন্মের অভ্যুত্থান বিবেচনায় ‘শূন্য অভ্যুত্থান’। প্রথম থেকেই এ নাম গ্রহণ করা হলে এবং পোশাকি পরিচয় হিসেবে তার যাত্রা অব্যাহত রাখা হলে এর যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তা চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে সবার মাঝে। তা না হলে, রাজা যায় রাজা আসে, জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না- একই কথা বলতে হবে, গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও। যাতে সেই অর্থে প্রাপ্তি হয় না কিছুই, উল্টো কিছুদিন পরপর অনেকগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যায়। জনগণ থেকে যায় সেই তিমিরে। পরিবর্তন হয় না তেমন কিছুই। একজন-একদলের জায়গায় কেবল অন্যজন যায়, অন্যদল আসে। এ কারণে নতুন চিন্তায় সংস্কার ও মেরামতে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। তাত্ত্বিকভাবেও আমাদের হাজির করতে হবে নতুন সংজ্ঞা, যার মাধ্যমে কেবল তথ্য হাজির করা হবে না, এর শক্তি, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হাজির করার অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষাও জারি থাকবে।

ছাত্র-জনতার এ রকম সংগ্রাম কখনো দেখেনি কেউ। ছাত্রদের একক নেতৃত্বেও যে এ ধরনের আন্দোলন সংঘটিত হতে পারে, তার নজির নেই কোথাও। চেনা পৃথিবীর জানা ইতিহাস বলছে, ছাত্রদের আন্দোলনে চার শতাধিকের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল শুধু চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের ছাত্র অভ্যুত্থানে। মাত্র ছয় দশকের মধ্যে বাংলাদেশ মুখোমুখি হলো তিনটি গণঅভ্যুত্থানের। সন অনুযায়ী যার পরিচয় ১৯৬৯, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নামে। শব্দদ্বয় ‘গণঅভ্যুত্থানে’র সঙ্গে এ দেশের মানুষ নিকট ও অতীত ইতিহাসে কোনোভাবেই অপরিচিত নয়, অনেক চেনা। কিন্তু অন্যান্য বারের ঘটনাসমূহের সঙ্গে এবারের প্রেক্ষাপট একেবারে আলাদা, স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভূ। এই তিন অভ্যুত্থান ছাড়াও ১৯৫২ সালে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পরই যার স্থান।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ওই সময়ের বাইরে সব থেকে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে শূন্য প্রজন্মের এই আন্দোলনে। প্রশ্ন হলো, শূন্য প্রজন্ম এ রকম একটা ইতিহাস রচনার শক্তি ও সাহস, শিক্ষা ও দীক্ষা পেল কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে যেভাবে, খুব সহজে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, তা আসলে কতটা গ্রহণযোগ্য, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত? বলা হচ্ছে এসবই সম্ভব হয়েছে জেড প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যের কারণে। এই প্রজন্ম সম্পর্কে অন্য সব প্রজন্মের কোনো ধারণা নেই যে, তাদের মানসগঠন কেমন ও কতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ। আদতে কি তাই? নাকি এর উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরে গিয়ে; এই মাটির গড়ন, এর আবহাওয়ার ধরন, নদীর বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতির রূপ ও জাতির বিকশিত হওয়ার কালপর্বের আলোকে ও অবলোকনে।

‘জেড প্রজন্ম’ বলতে কী বোঝায়, কী বলা হচ্ছে এর বিদ্যায়তনিক পরিভাষায়, কীই-বা এর বৈশিষ্ট্য? নয়-এর দশকের শেষাশেষি এবং শূন্য দশক ছাড়িয়ে আরও কিছুটা বর্ধিত সময়পর্বকে ‘জেড প্রজন্ম’ বলা হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যাদের জন্ম তারা এই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। এই অনুযায়ী এদের কেউ কেউ পড়ালেখা শেষ করে কাজে যুক্ত হয়েছে, কারও বা চলমান। এদের সবচেয়ে ছোট সদস্যের বয়স ১৩ বছর, জ্যেষ্ঠের ২৯ বছর। এরা মূল প্রতিনিধি। এই প্রজন্মের অভিজ্ঞতা বহুমাত্রিক। এরা প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমসমূহের সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়েছে। চাকরির চেয়ে এরা উদ্ভাবনে আগ্রহী। অন্যের মতামতের চেয়ে নিজস্ব মতামত ও পছন্দ দ্বারা এরা পরিচালিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বহুমাত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। করপোরেট দুনিয়ার প্রতি মনোযোগী। এদের অভিজ্ঞতায় যেহেতু কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি যুক্ত হয়েছে, এ কারণে অনেক বেশি বাস্তববাদী। চিন্তাভাবনায় বৈশ্বিকতা ও আধুনিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। এরা যেহেতু অনেক বেশি লক্ষ্যভেদী ও উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক- এ কারণে অন্য প্রজন্মের এদের সম্পর্কে ধারণা অপ্রতুল, অস্পষ্ট ও আবছায়ায় ঢাকা। জেড প্রজন্মের এসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমরা। এসবে কোনো প্রকার দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। অধিকতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সংযোজনের সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি।

দশক বলতে বোঝানো হয় সংখ্যার ক্রমিক ধারণাকে। যেমন দুইয়ের দশক হলো বিশ থেকে ঊনত্রিশ পর্যন্ত সংখ্যার সমাহার। ঠিক তেমনি শূন্য দশক হলো এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখায় সীমাবদ্ধ। লক্ষণীয় এখানে শূন্য দশকে ক্রমিক সংখ্যা কিন্তু নয়টা। একশ সংখ্যা সরাসরি এর ভেতরে আসে না। শূন্য যেহেতু এককভাবে কোনো নির্ণায়ক সংখ্যা নয়, এ কারণে শূন্য দশককে নয় সংখ্যাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু তার বাইরে গিয়ে যদি আমরা ভাবি তা হলে শূন্যের ক্ষমতা কিন্তু অসীম, অকল্পনীয় ও অসম্ভব রকমের। শূন্য সবকিছু ধারণ করতে পারে। শূন্য প্রজন্ম যা করে দেখাল বাংলাদেশে।

এক, দুই থেকে যে কোনো সংখ্যাকে যদি লক্ষ করা যায়, তা হলে দেখা যাবে সেখানে কেবল ওই সংখ্যা বা তার ধারাবাহিক সংখ্যা থাকে, অন্য কিছু নয়। যেমন এক-এর ভেতরে কেবলই এক থাকে। দুই-এর ভেতরে এক ও দুই। কিন্তু শূন্য একমাত্র সংখ্যা যার ভেতরে সব সংখ্যার বসবাস থাকে। এ কারণে শূন্যকে যে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে শূন্য হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ধারণা আমাদের কাছে তাও শূন্য। পৃথিবীর ধারণাও শূন্য। এমনকি আমাদের মাথার ওপর যে আকাশ, তার মান্যতাও কিন্তু আমাদের কাছে শূন্য হিসেবেই। শূন্যের এই অসীমতাকে আমরা মনে করি শূন্য প্রজন্মের ক্ষেত্রেও যৌক্তিক ও যথার্থ। এ কারণে ‘জেড প্রজন্ম’ প্রকৃতার্থে ‘শূন্য প্রজন্ম’। 

শূন্যের প্রায়োগিক ও শক্তিশালী যে ধারণা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নন্দিত তার স্রষ্টা কিন্তু আমাদেরই পূর্বপুরুষ আর্যভট্ট। যদিও খ্রিস্টীয় পঞ্চাশ শতাব্দীতে এই আবিষ্কারের আগেই মায়া ও মিশরীয় সভ্যতায় শূন্যের ধারণা ছিল, তবে বর্তমানের মতো করে নয়। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো ওই সময় শূন্যের ধারণার সঙ্গে ‘সুন্দর’-এর ধারণার যোগসূত্র ছিল। সেই ধারণা এখনো রয়েছে বলেই মনে হয়। এ কারণেই কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ, “শূন্য এ-বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়!/... কেঁদে নদী-জল করুণ বিষাদ ডাকে : ‘আয় ফিরে আয়’।। গগণে মেলিয়া শত শত কর/খোঁজে তোরে তরু, ওরে সুন্দর!”

শূন্যের ধারণা ছাড়াও চেহারার দিকে যদি আমরা তাকাই তা হলে কী দেখি আমরা? একটা আশ্রয়, একটা ভরসা, একটা প্রতীতি, একটা প্রত্যয়, একটা সম্ভাবনাও কি ওই বৃত্তের ভেতর দেখা মেলে না? যদি না দেখি তা হলে বুঝতে হবে শূন্যের চেহারা ও ধারণা কোনোটাই পরিষ্কার করে বুঝে উঠতে পারিনি আমরা। এ কারণেই বুঝি শঙ্খ ঘোষের উচ্চারণ, ‘শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে/ সে কথা জানো না?’

২০২৪-এ শূন্য প্রজন্ম প্রমাণ করে দিয়েছে শূন্যের ভেতরে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, হাহাকার, খেদ, ক্ষোভাগ্নি থাকে না কেবল, তার বিপরীতটাও থাকে। এ কারণে বাংলাদেশের বাংলা ভাষার ‘জেড প্রজন্ম’ প্রকৃতার্থে ‘শূন্য প্রজন্ম’। তাদের দ্বারা সংঘটিত এই আন্দোলনের পোশাকি নাম ‘গণঅভ্যুত্থান’। যার লক্ষ্য বৈষম্য নিরসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ বাস্তবায়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বাক্-স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাপূরণ, সমাজ-রাষ্ট্রে নৈতিকতা ও ন্যায্যতার অনুশীলন এবং মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়ন। এসব যদি না হয় পূরণ ও থেকে যায় খামতি তা হলে বুঝতে হবে আমরা শূন্যের গুণিতক ভূমিকাকে বেছে নিয়েছি, সম্ভাবনাকে নয়। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ আকাঙ্ক্ষার এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের প্রতীতি হোক, ‘শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।’

শূন্য প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আমাদের একটাই নিবেদন, তারা যেন মনে রাখেন, জাতির যেকোনো বড় ঘটনায় প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে সবাই অংশগ্রহণ করে। সবার প্রকাশভঙ্গি হয়তো এক নয়। সামান্য কিছু লোক হয়তো এর বিপক্ষে থাকে। কিন্তু তারাও কী কারণে এবং কোন বিবেচনায় এমনটা করেছে, তাও আমলে নেওয়া দরকার। তা না-হলে সমাজে বিভক্তি বাড়ে শুধুই। রাষ্ট্রের সংহতি ও অগ্রসরতা বাধাগ্রস্ত হয়। ১৫ বছর ধরে শুধু শব্দ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারকে বুঝতে চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ কোন চিহ্নের কারণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আরেকজন রাজাকার, তা পরিষ্কার করা হয়নি কখনোই। যাকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হচ্ছে কিংবা যাকে রাজাকারের তকমা দেওয়া হচ্ছে, সেটা কোন চিহ্নের আলোকে, কতটা তার আদ্যপান্ত আর নাড়ি-নক্ষত্রের খবর নিয়ে বলা হচ্ছে? কারণ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজাকার তকমা দেওয়া হয়, তখন তার জন্মের ঠিকুজি জানা জরুরি। যদি সেটা না করা হয়, তাহলে কি এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? আদতে কি তার ভেতরে ওই শব্দদ্বয়ের যে চিহ্ন তার কোনো একটি হাজির রয়েছে, নাকি নিজেদের মর্জিমতো ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে? প্রশাসনকে কবজা করে তা হয়তো সাময়িক করা যায়, কিন্তু আখেরে তার পরিণতিও পেতে হয়। নিজেদের মর্জি মতো মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার খেলার বিস্ফোরণ কেমন হতে পারে, শূন্য প্রজন্মের এই অভ্যুত্থানে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে নিশ্চয়।

একই কথা বলা যায়, অতি সম্প্রতি বহুল ব্যবহৃত ‘দালাল’ শব্দের ক্ষেত্রে। যাকে বা যাদের ‘দালাল’ বলে ‘রাজাকার’ বা ‘জামাত-শিবির’ শব্দের মতো তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আসলে তিনি বা তারা দালাল তো? দালাল যে তার চিহ্নগুলো কি পরিষ্কারভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে? শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা হচ্ছে, নাকি জিঘাংসাও কাজ করছে। যে বা যারা দালাল নন, তাদের যদি দালাল বলা হয়, তাহলে তাদের কিন্তু প্রকারান্তরে হত্যার মতো অপরাধ করা হচ্ছে। এখন যে দালাল তো নয়ই, উল্টো নানাভাবে পতিত স্বৈরাচার কর্তৃক নিগৃহীত, কিন্তু তা মুখ ফুটে কখনো বলেননি কখনোই। কিংবা বলেছেন, আপনার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাকে যদি ‘দালাল’ বলা হয়, তাহলে তার চেয়ে গভীরতর বেদনার আর কী হতে পারে? মনে রাখতে হবে, চিহ্ন না বুঝে, না দেখে যারা তকমা ব্যবহার করে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু সুবিধার নয়। এরা বিভক্তি বাড়িয়ে ফায়দা লুটতে চায়।

বিপ্লবের প্রতিবিপ্লব থাকে, এসব হয় চিহ্ন পরিষ্কারভাবে না-বুঝে ওঠার কারণে। জুলাই অভ্যুত্থানের সেই চিহ্নের নাম ‘শূন্য’। যাদের ব্যাকরণের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘জেন জি’, আমরা বলছি ‘শূন্য প্রজন্ম’। সুতরাং শুধুই আলটপকা শব্দ ব্যবহার নয়, বাক্যবাগীশদের উল্লম্ফন দেখে নয়, শব্দের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে, চোখ রাখি চিহ্নের প্রতি এবং যার যা প্রাপ্য, তাকে সেটুকু দেই। যদি কিছু নাও দিতে পারি, মিথ্যের বেসাতিতে ট্যাগ যেন না লাগাই, অপমান যেন না করি। অপমানের ভয় সে-তো ভয়ের সংস্কৃতিরই আরেক রূপ। বাংলাদেশের নবজাগরণের এই শুভলগ্নে, আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ নির্মাণের এই আশা জাগানিয়া সময়ে, আসুন, আমরা যার যার অবস্থান থেকে শূন্য প্রজন্মকে বুঝি, ওদের পাশে থাকি, সাহসে সাহস রাখি শুভ এক আগামীর প্রত্যাশায়। কারণ, শূন্যের ভেতরেই রয়েছে সম্ভাবনার বাংলাদেশ।

লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক