রীতা মন্ডল নিজের করা ডিজাইনে কাঠ ব্লক আর হাতের কাজের পোশাক বিক্রির মাধ্যমে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছেন Adriel's Collection's (আদ্রিল’স কালেকশন্স) এর কাজ। এখন ব্লক, বাটিক, হ্যান্ডপেইন্ট কাজের পোশাকের সঙ্গে যুক্ত করেছেন যশোরের হাতের কাজের নানা পণ্য। এ ছাড়াও নারিকেলের আইচা ও শণের তৈরি পণ্যও বিক্রি করেন রীতা। আদ্রিল’স কালেকশন্স-এর যাত্রা শুরু হয় শুরু ২০১৯ সালের ৬ মে মাসে। রীতা মন্ডলের শিবুরি বাটিক গজ কাপড় এবং হাতের কাজের পণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
রীতার জন্ম যশোরের একটি ছোট্ট মফস্বল শহরে। পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা যশোরেই। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন যশোর আব্দুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজ থেকে এবং অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন এই ভেবে যে, পড়া শেষ করে ভালো কোন ব্যাংকে চাকরি করবেন বা কলেজের প্রফেসর হবেন। রেজাল্টও ভালো করতেন সব সময়। দুই স্বপ্নের কোনোটিই পূরণ হয়নি তবে তিনি হয় উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। যার কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১০জন কর্মী।
রীতা মন্ডল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘শুরুটা করি বাড়িতে টুকটাক নিজ হাতে কাঠ ব্লকের কাজ দিয়ে থ্রি-পিস বানিয়ে এবং যশোরের হাতের কাজের পোশাক দিয়ে। তারপর হুট করে চিন্তা আসে অনলাইনে পেইজ খোলার। কি নাম দেবো ভেবে ভেবে হঠাৎ মনে হলো মেয়ের জন্য যেহেতু চাকরি করতে পারছিনা, ওকে সময় দেবার জন্যই ঘরে থাকা। তাই ওর নামটাই হোক আমার পেইজের। ওর নাম Adriel Arattrika । এই নামের প্রথম অংশটাই হলো আমার পেইজের নাম।’
প্রথমত পারিবারিক বাধা, পুঁজির অভাব, তারপর স্বল্প পুঁজি দিয়ে সঠিক কাঁচামালের সোর্স না পাওয়ার সমস্যা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হয়েছে রীতা মন্ডলকে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকায় পণ্য ডেলিভারিতে নানা ধকল পোহাতে হয়েছে তার।
রীতা মন্ডল বলেন, ‘ডেলিভারি খরচ বেশি হয়ে যেত আর তখন কাস্টমার থেকে বেশি চার্জ চাইলে মনোমালিন্যতার সৃষ্টি হতো।’
কিন্তু প্রতিটি সফলতা পেছনে এমন বাধার গল্প যেমন থাকে তেমনি থাকে অনুপ্রেরণার গল্পও। রীতা মন্ডল বলেন, ‘আমার উদ্যোগের শুরুতেই আমাকে অর্থ এবং মানসিকভাবে অনেক সাহায্য করেছে আমারই বাড়িওয়ালা ভাবি। সিরাজগঞ্জ বাড়ি তার। বরের চাকরি সূত্রে তার বাসায় ভাড়া ছিলাম। ভাবির সহযোগিতা পেয়েছিলাম বলেই ব্যবসা শুরু করতে পেরেছিলাম। সাথে আমার বড় বোনও সহযোগিতা করেছেন। কিছুদিন পর বর যখন দেখলেন— আমি অল্প সময়েই ভালো কাজ করছি তখন থেকে তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করা শুরু করেন।’
জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কোনো একটি ঘটনা মানুষের জীবনে আত্মবিশ্বাসের কারণ হয়ে যায়। হয়তো তার সঙ্গে সুখ কিংবা দুখের গল্প জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস মানুষকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকদূর।
রীতা মন্ডল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবার আগ পর্যন্ত খুব কম মেলামেশা করেছি আমি মানুষের সাথে। চুপচাপ থাকতে আর নিজের বইপত্র নিয়ে থাকতেই পছন্দ করতাম। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য মা টিউশন দিতে পারতেন না। তাই নিজে চেষ্টা করতাম যেন পড়াশোনাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন এলাকার একজনের কাছে মোবাইল থেকে রেজাল্ট দেখার জন্য গেলে তিনি বলেন— ও আর কিই বা পাস করবে আর পাস করলেও টেনেটুনে। খালি খালি আমার মোবাইলের টাকা নষ্ট। তার কথা শুনে চলে গেলাম স্কুলে রেজাল্ট নিতে। রেজাল্ট হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম তাকে দেখালাম। আর বলেছিলাম, আমার চেষ্টা শক্তি অনেক। সেদিন যেন আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। আমার মধ্যে জেদ উঠেছিল আমি নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবো।’
সেই চেষ্টায় অনেক দূর এগিয়েছেন রীতা। তার উদ্যোগের পণ্য প্রসারে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করে যাচ্ছেন। রীতা বলেন, ‘আমার হাউসের পণ্যের প্রচারে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, হাউসের ফেসবুক আইডি, ফেসবুকের বিভিন্ন বিজনেস গ্রুপ এবং ইন্সট্রাগ্রাম ও হোয়াইটসএপকে বেছে নিয়েছি আমি।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রীতা বলেন, উৎসবে বিক্রি বেশি হয়। তখন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্তও আয় করেছেন। স্বপ্ন দেখেন অদ্রিল’স কালেকশন্সের পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি করবেন। রীতা মন্ডলের স্বপ্ন পূরণ হোক। দেশের পণ্য বিদেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ুক।