প্রায় ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিলো ঢাকা শহর। এই শহরে প্রথম কীভাবে গাড়ি এসেছে সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা আছে। শুরুর দিকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো পালকি। এরপর ঢাকায় যারা বসবাস করতেন একসময় তারা ব্যবহার করতেন ঘোড়ার গাড়ি। এরপর ২০ শতকের শুরুর দিকেই ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ব্যবহার শুরু করেন ব্যক্তিগত গাড়ি। জানা যায়, ঢাকার প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে। পরিবহন ব্যবসার যাত্রা শুরু জয় সর্দার মাওলা বখশের মাধ্যমে। যার বাসগুলো পরিচিত মুড়ির টিন নামে। সেই গাড়ি চলত ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নয়ারহাট, ঢাকা-মিরপুর, ঢাকা-ডেমরা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। জনসাধারণের জন্য ট্যাক্সি সার্ভিস চালু হয় তিরিশের দশকেই। আপনি জানেন এসব গাড়ি চালানোর জন্য তেলের যোগান আসতো কোন পাম্প থেকে? জানা যায়, ঢাকার প্রথম তেলের পাম্প কিউ.জি সামদানী এন্ড কোং। এটি ২৮, ভিক্টোরিয়া পার্ক, ঢাকায় অবস্থিত। পাম্পটি প্রতিষ্ঠা করেন কিউ.জি সামদানী।
পুরান ঢাকার কিউ.জি সামদানী এন্ড কোং একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত। এটির আশেপাশে রয়েছে বাহাদুর শাহ পার্ক, জজ কোর্ট, জগন্নাথ কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, শাখারীবাজার, লক্ষীবাজার, মহানগর মহিলা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, আজাদ সিনেমা হল, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল, বিউটি বোর্ডিং, ক্যাফে কর্নার, বাংলাবাজার ইত্যাদি।
কিউ.জি সামদানী এন্ড কোং পাম্পটি বাহাদুর শাহ পার্কের পাশেই। অন্যান্য পাম্পের মতো বেশি জায়গা নেই, নেই পার্কিং ব্যবস্থা। পাম্পের সামনেই লেখা ‘ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহরের প্রথম পেট্রোল পাম্পে আপনাদেরকে স্বাগতম’। পাম্পটির নাম এটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী গোলাম সামদানীর নামে। গোলাম সামদানীর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায়। ত্রিশের দশকে কুমিল্লা থেকে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে আসেন তিনি। এরপর শুরু করেন ব্যবসা। শুরুতে ইমপোর্টের ব্যবসা করেন সামদানী এরপর ঢাকায় তেলের পাম্প চালু করেন। ১৯৫০ সালের দিকে এই পাম্পের যাত্রা শুরু হয়। এই পাম্পের জন্য শুরুতে তেল আসতো নদীপথে বিট্রেন থেকে।
এই পাম্পটির নামে আরেকটি পাম্প রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের পাশে অর্থাৎ নীলক্ষেতে। যার প্রতিষ্ঠাতাও কিউ.জি সামদানী। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৬ সালে। এরপর এসবের দেখভাল করেছেন কিউ.জি সামদানীর ছেলে কাজী সাজ্জাদ জিলানী। সামদানীর ৯ সন্তান। তাদের কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে পাম্পটির দেখাশোনা করছেন কিউ.জি সামদানীর ছেলে ফিরোজ সামদানী। যার ডাকনাম পাবলু। দীর্ঘদিন জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর মায়ের অনুরোধে বাবার ব্যবসার দেখভাল করছেন তিনি।
ফিরোজ সামদানী রাইজিংবিডিকে জানান, জন্মের পর থেকেই পাম্প দেখছি। ছোটবেলা থেকেই আব্বার সাথে আসতাম এখানে। ঢাকার তখন দারুণ রূপ ছিলো মানুষ কম ছিলো একেবারেই। বাহাদুর শাহ পার্কে একেকটা গাছ ছিলো অনেক বড় বড়। অনেক সবুজ ছিলো, ফুল ছিলো। ৫ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে রিক্সায় বাড়ি ফিরতে হতো। ইলিশ মাছের দাম ছিলো ৭০ পয়সা। বুড়িগঙ্গার পানি সেসময় খাওয়া যেতো। এপার ওপার সাঁতরাতাম। এখনতো আর কেউ নদীতেই নামেনা। এরপর আমি পড়াশোনার জন্য জার্মানিতে পাড়ি জমাই, যুক্তরাষ্ট্রেও থেকেছি লম্বা সময়। এরপর মায়ের অনুরোধে ঢাকায় ফিরি এবং পাম্পের দায়িত্ব নেই।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পাম্পে শুরুর দিকে তেল আনা হতো ক্যানে করে। সে সময় ঢাকায় খুব বেশি গাড়ি ছিলো না। প্রথমে তেল আসতো ব্রিটিশ কোম্পানি স্টান্ডার্ড ভ্যাকিউম ওয়েল কোম্পানি থেকে। এরপর তেল নেওয়া শুরু হয় ইসসো ওয়েল কোম্পানি এবং বার্মা ওয়েল কোম্পানি থেকে। আমরা ক্যালটেক্স অয়েল কোম্পানি থেকেও তেল নিতাম। এসব দেখভাল করতো ব্রিটিশরা। এরপর স্বাধীন দেশের সরকার কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব নেয়। ইসসো এর নাম বদলে রাখা হয় মেঘনা, বার্মার নাম রাখা হয় পদ্মা, ক্যালটেক্স এর নাম রাখা হয় যমুনা। সরকার তিন নদীর নামে এসবের নামকরণ করে।’
‘আমার আব্বা ঢাকায় প্রথম তেলের পাম্প চালু করেন। তেলের ব্যবসায় ভালো করার জন্য ব্রিটিশদের এসসো অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলো ৬০-৬২ সালের দিকে। সে সময়কার মুড়ির টিন গাড়ি বেশি ছিলো এবং কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি ছিলো ।’- যোগ করেন ফিরোজ সামদানী।
এক সময় এক দুইজন কর্মচারী দিয়ে পরিচালিত হতো এই তেলের পাম্প। বর্তমানে ১১ জনের বেশি কর্মচারির মাধ্যমে পাম্পটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে রাত ৩ টা পর্যন্ত পাম্প চালু থাকে। একসময় রাত ৮-৯ টা বাজেই বন্ধ হতো পাম্পের কার্যক্রম। আগে হাত দিয়ে তেল দেওয়া হতো এখন মেশিনেই সব হয়।
সাভার পরিবহনের ড্রাইভার আলম মিয়া বলেন, ‘শুরু থেকেই সদরঘাট এলাকা থেকে নানা জায়গায় বাস চালাই। প্রায় ৩৫-৪০ বছর এই গাড়ির লাইনে। খুব বেশি পাম্প সে সময় দেখিনি এই পাম্প থেকেই আমরা তেল নিয়ে থাকি।’
পুরান ঢাকায় বাসিন্দা লেখক এম হাসান আলী বলেন, ‘বাহাদুর শাহ পার্কের নিকটে স্থাপিত কিউ.জি সামদানী এন্ড কোং ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প পরিচিতি থাকলেও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জেনেছি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম পেট্রোল পাম্প হিসেবে সড়ক ভবনের কাছে রমনা পেট্রোল পাম্প গড়ে উঠেছিল। তবে বেসরকারি খাতে কিউ.জি সামদানী এন্ড কোংকে ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প উল্লেখ করা যায়।’