মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকরা মাদারীপুর থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পাচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছে। এতে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন অফিস তদন্ত কমিটি গঠন করায় প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। এরই মধ্যে এক নির্বাচন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জাদির মুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা জমিলা খাতুন। বাবা নাম আবুল কালাম এবং মার নাম মাহমুদা খাতুন। অথচ তিনি গত ১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চরজানাজাত এলাকা থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন। আবেদন করেছেন পাসপোর্টের জন্য। তিনি যে ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন, সেই এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও ওই নামে কাউকে চেনেন না। চরজানাজাত ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসির সরকার বলেন, ‘জমিলা খাতুন নামে যে নারীর কথা বলা হয়েছে, তিনি এ ইউনিয়নের বাসিন্দা নন। তাকে আমি চিনি না।’
অভিযোগ রয়েছে, মাদারীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলী আহম্মদ এবং শিবচর উপজেলা নির্বাচন কর্মকতা এস এম কাদেরের জোগসাজশে মোটা অংকের টাকার বিনিময় এই রোহিঙ্গা নারীকে ভোটার তালিকায় না লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জমিলা খাতুন ও তার স্বামী মুক্তাবিজ ইসলাম পরিবারসহ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জাদির মুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩ নম্বর ব্লকে বসবাস করতেন। কয়েক বছর আগে মুক্তাবিজ ইসলাম বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বর্তমানে সৌদি আরব অবস্থান করছেন। এরপর তার স্ত্রী জমিলা খাতুনকে সৌদি আরব নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের নাগরিক বানিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, মাদারীপুরের স্থানীয় ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা একাধিক রোহিঙ্গা। টাকার বিনিময়ে এমনটা করছেন নির্বাচন অফিসের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। গত ১ অক্টোবর মাদারীপুর সদর উপজেলায় এক নাগরিক ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ভোটার হতে আসে। পরে তার জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে না পাওয়ায় তার ভোটার হওয়ার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) বানিয়ে পাসপোর্ট করে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে চলে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা তাদের নাম-পরিচয় গোপন করে স্থানীয় কোনো পরিবারের স্বামী-স্ত্রীকে বাবা-মা বানিয়ে জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচন অফিসের কতিপয় কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ভোটার আইডি কার্ড বানাচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধিকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এনআইডি তৈরি করছে। পাসপোর্ট বানিয়ে বাংলাদেশি সেজে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। একটি এনআইডি তৈরি করতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র।
অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া প্রসঙ্গে জমিলা খাতুনের স্বামী সৌদি আরবে অবস্থানরত মুক্তাবিজ ইসলাম হোয়াটসআপে দাবি করেন, তিনি মিয়ানমারের নাগরিক হলেও তার স্ত্রী জমিলা খাতুন বাংলাদেশের নাগরিক।
মুক্তাবিজ ইসলাম কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়েছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, ‘আমি রোহিঙ্গা হয়েছি, তাতে কী হয়েছে? রোহিঙ্গারা কী বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাবে না?’
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ভোটার হচ্ছে। এ দায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন অফিস এড়াতে পারে না। টাকার বিনিময় ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ নয়। কমপক্ষে পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করে এ কার্ড পাওয়া যায়। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর তথ্য সংগ্রহ, পরিচিতি যাচাই, উপজেলা সার্ভারে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আবেদনকারীকে এনআইডি কার্ড দেওয়া হয়। এ জন্য বেশ সময়ও লাগে। উল্লিখিত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যদি কার্ড পেয়ে থাকে, তাহলেও বলতে হবে এক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।
অভিযুক্ত উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এস এম কাদের বর্তমানে ভোলা জেলা নির্বাচন অফিসে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাদারীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলী আহম্মদ নিজের দায় অস্বীকার করে বলেন, ‘শিবচর উপজেলায় এক রোহিঙ্গা নারী ভোটার হয়েছে, এমন ঘটনা জানার পর পুলিশ সুপারকে তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করেছি। পরে পুলিশ সুপারের তদন্তে বিষয়টি সত্যতা পাওয়া যায়। পরে আমরা সেই রোহিঙ্গা নারীর নাম তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছি।’
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলী আহম্মদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের শৃঙ্খলা শাখা থেকে অভিযুক্ত এস এম কাদেরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে কি-না জানা নেই। তবে গত ১ অক্টোবর মাদারীপুর সদর উপজেলায় এক নাগরিক ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ভোটার হতে আসে। পরে তার জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে না পাওয়ায় তার ভোটার হওয়ার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।’