গোপাল ভাজা, বয়স ১২ বছর। তার মা মারা গেছে অনেক বছর আগেই। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা রিপন ভাজা আবার বিয়ে করেন। নতুন সংসারে শিশু গোপালের ঠাঁই হয়নি। বাবাও আর ছেলের খোঁজ রাখেননি। বাধ্য হয়েই গোপালকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়। গোপালের সঙ্গে তার ছোট ভাই জয়ন্ত ভাজারো ঠাঁই হয়নি কোথাও।
বর্তমানে গোপাল ও জয়ন্ত মানিকগঞ্জ শহরের খালপাড় সেতুর নিচে বসবাস করছে। একবেলা খেয়ে না খেয়ে জীবন চলতে থাকে দুই ভাইয়ের। এক সময় তারা ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
মানিকগঞ্জ শহরের বেশিরভাগ ভবঘুরে শিশুরা খালপাড় সেতুর নিচে সময় অতিবাহিত করে। শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে বসবাস করলেও খালপাড় সেতুর নিচে এসব শিশুরা ড্যান্ডির নেশা করে। প্রথমদিকে আশেপাশের মানুষ শিশুদের আর্থিক সহযোগিতা করলেও এখন করছেন না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সহযোগিতার টাকা দিয়ে খাবার না খেয়ে ভবঘুরে শিশুরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে। যে কারণে তারা সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছেন। ভবঘুরে শিশুদের পুর্নবাসনে প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় অন্ধকারে ডুবতে বসেছে তাদের ভবিষ্যৎ।
ভবঘুরে শিশুদের একজন রোকসানা (১৩)। জয়ন্ত ও গোপালের সঙ্গে তারও বসবাস। রোকসানার বাবা মারা গেছেন অনেক বছর আগেই। মা খুব অসুস্থ। জয়ন্ত ও গোপালের সঙ্গে থাকতে থাকতে রোকসানাও নেশায় আসক্ত। শুধু রোকসানা, গোপাল ও জয়ন্ত নয়, তাদের মতো আরো ভবঘুরে শিশুরা নেশায় আসক্ত।
গোপাল ভাজা বলে, ‘সুন্দর জীবন ক্যারা না চাই। ঠিকমতো খাওন পাই নে। হগলেই আমাগো দেইখা যাই। কেউ আদর করে না।’
নেশা কেন করো এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি সে।
রোকসানা বলেন, ‘আমাগো জীবন তো নষ্ট অইয়া গেছে। কেউ খোঁজ নেই না।’
সুন্দর জীবন চাও কিনা এমন প্রশ্নে সে বলে, ‘অনেক লোকজন আইসা কথা দেই। নাম ঠিকানা নিয়া যাই। তারপর আর কেউ আসে না।’
বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী রুবেল মিয়া বলেন, ‘শহরে ভবঘুরে শিশুরা দোকানের কাছে আসলে মাঝেমাঝে ফলমূল খেতে দেই। মাঝে মাঝে ওরা টাকা চাই। টাকা দিলেই ওরা নেশা করে। ওদের জন্য মন কাঁদলেও কিছু করার সামর্থ্য নেই। প্রশাসন চাইলে ওদের ভবিষ্যৎ বাঁচতে পারে।’
খালপাড় এলাকার সাজ্জাদ আরেফিন বলেন, ‘প্রতিটি শিশুর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব। আমরা নাগরিক হিসেবে যতটুকু সম্ভব ওদের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করি। স্থায়ীভাবে ভবঘুরে শিশুদের পুর্নবাসন করে ওদের আলোর পথে নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি প্রশাসনের কাছে।’
প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক শাহিনুর রহমান বলেন, ‘দিন দিন ভবঘুরে শিশুরা অযত্ন অবহেলায় অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাবন করছে। তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ না ঘটলে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এনজিওদের মাসিক সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।’
মানিকগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন বলেন, ‘ভবঘুরে শিশুদের দুস্থ ও পুনর্বাসনের সুযোগ রয়েছে। যাচাই বাছাই শেষে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ প্রদান করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড.মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘সরকারি বিধি বিধান অনুযায়ী শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রশাসন কাজ করছে। ভবঘুরে শিশুদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’