ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে ডিএমপিকে টেনে তোলা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে পুলিশ সংস্কার, পুলিশ কমিশন, পোশাক পরিবর্তনসহ নানা দাবি-দাওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে সফলতা বা ব্যর্থতা মূল্যায়ন করাও কঠিন।
সোমবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এছাড়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডি ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাকসুদুর রহমান।
রাইজিংবিডি: ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস হলো। নিজেকে কতটা সফল বা ব্যর্থ মনে করছেন? মো. মাইনুল হাসান: আমি যখন এখানে দায়িত্ব নিয়ে আসি তখন আমাকে রিসিভ করার মতো কোনো লোকবল ছিল না ডিএমপি কমিশনার অফিসে। আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। থাকবেই বা কি করে, যে যার মতো তখন জানের ভয়ে অস্থির। ব্রকেন ডাউন, ডিজাস্টার অবস্থায় ছিল পুলিশ। কিন্তু যেহেতু আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমাকে আসতে হয়েছে।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন এলাকায় তখন কর্মবিরতি চলছিল, পুলিশের তখন একটা বিদ্রোহ অবস্থা।তবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আসছে। ডিএমপি এলাকায় যারা নিহত হয়েছেন ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী তাদের দাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা করেছি।আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। যারা অপরাধী নয়, কিন্তু বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল তাদের আমরা কাউন্সিলিং করেছি। আমরা তাদের আহ্বান করেছি, আমরা নতুন নেতৃত্ব, নতুন করে সব শুরু করবো। আগের নেতৃত্বে চলবে না পুলিশ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের যে বিরোধ, মুখোমুখি অবস্থা, আস্থাহীনতা, সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে জনগণের আস্থা ছাড়া পুলিশিং সম্ভব না। রাষ্ট্র যে গুরুত্ব দিয়েছে পুলিশের ওপর তা তো মানতে হবে। আমাদের এজন্য দরকার সবার সমর্থন ও সহযোগিতা।
রাইজিংবিডি: সশস্ত্র বাহিনী আপনাদের কোনো সহযোগিতা করেছে? মো. মাইনুল হাসান: সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এটা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ও স্বীকার করি। জীবনের ভয়ে যারা কর্মে না ফিরে বা কর্মস্থলে না থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেসব প্রাণভয়ে ভীত সদস্যদের তো ফেরাতে হতো। সশস্ত্র বাহিনীর কারণে কর্মক্ষেত্র নিরাপদ হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা ফিরেছেন। এখন সব থানায় কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
রাইজিংবিডি: বর্তমানে ডিএমপির অবস্থা কেমন? মো. মাইনুল হাসান: আবার গণবিপ্লব, সরকার পতন পরবর্তীতে পুলিশকে ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা কি নিরাপত্তা বিধানে কাজ করবে, তারাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। তবে জনগণই সাপোর্ট করেছে। মানুষই চেয়েছে পুলিশকে দরকার। পুলিশকে ফিরতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম দিয়ে কিন্তু পুলিশ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশ, বিশেষ করে ডিএমপি। ডিএমপির ২২টি থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ ২০০ এর বেশি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪ জন নিহত হয়েছেন। পাঁচশ’র মতো আহত হয়েছেন। তাদের অনেকে সুস্থ হয়েছেন। এখনো বেশ কয়েকজন (১৫ জন) চিকিৎসাধীন আছেন। ডিএমপির ১৮০০ এর বেশি অস্ত্র লুট হয়। তবে ডিএমপি স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার পর ১১০০ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকে নিজেরা জমা দিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোর মেরামতের কাজ শেষ। ডিএমপির দুটি থানা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পল্টন ও যাত্রাবাড়ী। এ দুটি থানাও আগামী সপ্তাহের মধ্যে চিরচেনা চেহারায় হবে। তবে ৫০ থানার কার্যক্রম থেমে নেই।
রাইজিংবিডি: যাদের বিতর্কিত ভূমিকা ছিলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কী? মো. মাইনুল হাসান: অনেকে ইতোমধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন। সাসপেন্ড হলে তদন্ত হবে। তদন্তে যে ব্যবস্থা হয় তাই হবে। আর অনেকের নামে তো মামলা আছেই। সেই মামলায় প্রচলিত আইনে যা হওয়ার তাই হবে।
রাইজিংবিডি: জঙ্গিবাদ কী অবস্থায় আছে? শঙ্কার মতো পরস্থিতি কিনা? মো. মাইনুল হাসান: আশঙ্কার জন্যই তো আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আমাদের সিটিটিসি আছে। এর বাইরে তো অন্যান্য বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী সেল বা ইউনিট আছে। কারাগার থেকে বা মামলা থেকে জামিন পাওয়া তো আইনি অধিকার। সেখানে তো পুলিশ বাধা দিতে পারে না। তবে যারা জামিন পাচ্ছেন তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
রাইজিংবিডি: নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরির ঢাকার অনেক জায়গায় শোডাউন মিছিল-মিটিং করছে এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? মো. মাইনুল হাসান: একটা নিষিদ্ধ সংগঠন লুকায়-ছাপায় করতে পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে করার কারণে আমরা তিনটা মামলা করেছি। মিডিয়া কো-অর্ডিনেটরকে গ্রেপ্তার করেছি। কেউ যদি পকেটে করে পতাকা নিয়ে হুটহাট শোডাউন মিছিল করে ছবি তুলে চলে যায় তাহলে তো মুশকিল। তাছাড়া তাদেরও তো নিষিদ্ধ সংগঠন বলে আত্মগোপনের কৌশলও আছে। আমরা বসে নেই। কাজ করছি, যাকে পাবো তাকেই ধরা হবে।
আমাদের প্রিভেন্টিভ অ্যাকশনের পাশাপাশি ইনভেস্টিগেশন চলছে।আমাদের ইনটেলিজেন্স দেবে কে? সবাই দেবে, আমাদেরকে জানান। সাপোর্ট দেন আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, করবো।পুলিশ মিনিমাম ফোর্স এপ্লাই করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে। আইন-নিয়মকানুনের মধ্যে থেকেই তো আমাদের কাজ করতে হয়। আর পুলিশ তো কমিউনিটির বাইরে না, আমরা সবাই কমিউনিটিতে কাজ করি। পুলিশের শক্তির উৎসই হচ্ছে সাধারণ জনগণ।
রাইজিংবিডি: রাজধানীতে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব কী? মো. মাইনুল হাসান: ছিনতাই সমস্যা ঢাকার নতুন সমস্যা না। ভাসমান, বেকারত্ব, পারিবারিক পরিবেশে থাকা না থাকাসহ অনেক সামাজিক কারণে ছিনতাই বাড়ে। পুলিশ তো প্রতিরোধমূলক কাজ করে। কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং আছে। পুলিশের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আছে বলেই আমরা নগরবাসী প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে পারছি। এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ফাঁকগলে যখন কোনো অপরাধমূলক কাজ হয়ে যায় তখন ইনভেস্টিগেটিভ উইং আছে, তারা কাজ শুরু করে। অপরাধ হয়ে গেলে মামলা হবে।
রাইজিংবিডি: ঢাকার যানজট নিরসনে নতুন কমিশনার হিসেবে আপনার পরিকল্পনা কী? মো. মাইনুল হাসান: ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক এডুকেশন, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং। ট্রাফিক এডুকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাস্তা যারা ব্যবহার করেন, পথচারী, যানবাহন চালক। তাদের মার্কিং করলে অধিকাংশরাই পাস মার্কস পাবেন না। রাস্তার মাঝে স্টপেজ, যত্রতত্র পারাপার। আবার ট্রাফিক এডুকেশনের কাজটা কিন্তু পুলিশ করে না।
মূলত ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং রাস্তার প্রশস্ততা, রাস্তার অবস্থা, রাস্তার সংখ্যা, ব্যবহারকারীর সংখ্যা, রাস্তার যে নানামুখী ব্যবহার, পার্কিং সুবিধা সবকিছু কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং এর আওতায়। এই নগরীর ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রেও কিন্তু পাস মার্কস দেওয়া সম্ভব না। রাস্তা খারাপ হলে বা স্পেসের তুলনায় যানবাহন বেশি হওয়াটা তো পুলিশের দোষ অথবা দায় নেই।
অন্যদিকে, এনফোর্সমেন্টের সঙ্গে জড়িত পুলিশ। এখন ট্রাফিক এডুকেশন আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর দায় নিয়ে পুলিশ এনফোর্সমেন্টের কাজে যখন সড়কে থাকে তখন দায়টা কিন্তু মানুষেরও। তবে পুলিশেরই দায়টা বেশি দেখে। আমরা যেভাবে ট্রাফিকটা মেইনটেইন করি অনেকটা লেবার সিস্টেমে। যতো বেশি শ্রম দিবো ততো বেশি স্মুথ হবে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর মুভমেন্ট বা আন্দোলন বলতে অনেক গ্রুপ চলে আসছে সড়কে। যারা বিগত ১৫ বছর সড়কে নামতেই পারেননি। এখন আমরা চেষ্টা করছি নিবৃত করতে। রাস্তা বন্ধ করলে তো ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করবেই। আবার আমরা যদি এনফোর্সমেন্টে যাই, রাস্তা ব্লক বা জনভোগান্তি কমাতে পুলিশ চেষ্টা করে তখন অনেকে বলতে পারে যে, পুলিশের চরিত্র বদলায়নি, সেই আগের মতোই হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা করবোটা কী? আমরা তো চাইলেই ইনফোর্স করতে পারি।
অন স্ট্রিট পার্কিং এর ব্যবস্থা। অর্থাৎ অনিয়মের শহর ঢাকা, এখানে সড়কে পার্কিং সুবিধা দিলে সেটার অপব্যবহার করা হয়। দোকান চলে, ভাড়া দেওয়া হয়। আবার যেখানে বহুতল ভবন হচ্ছে সেখানে যে পরিমাণ স্পেস থাকার কথা পার্কিংয়ের জন্য তা করা হচ্ছে না। প্রত্যেকটা কারণ শনাক্ত করে যদি সংশ্লিষ্টরা সমাধানে এগিয়ে না আসেন তাহলে তো সমস্যা থেকেই যাবে। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাইজিংবিডি: নতুন করে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবেন কিনা? মো. মাইনুল হাসান: ঢাকা অনেক বড় শহর। অথচ কোনো ট্রাফিক কন্ট্রোরিং সিস্টেম নেই। এটা আনা তো জরুরি, আমরা চিন্তা করছি একটা সেমি-অটোমেশন সিস্টেম চালু করবো। কারণ ফুল অটোমেশনের জন্য যে পূর্ব শর্তগুলো পূরণ হওয়া দরকার সেগুলো তো নাই। এর আগে অনেক পজিটিভ প্রজেক্ট ফেইল করেছে। কারণ ইন্টার সেকশন ঘনঘন, এক সড়কে নানা ধরনের যান চলে, বিকল্প রাস্তা নাই, পার্কিং সুবিধা অপ্রতুল, ভিআইপি মুভমেন্ট তো আছেই। এই অবস্থার উন্নতি না হলে ফুল অটোমেশন সম্ভব নয়। তাই আমরা সেমি অটোমেশন পদ্ধতির কথা ভাবছি। এটা করলে সমস্যা কিছুটা কমবে। আমি ট্রাফিকে ডিসি হিসেবে কাজ করেছি। এই ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা, সমস্যা সংক্রান্ত বহু গবেষণা আছে। ৩৫/৪০ ধরনের সমস্যা আছে ট্রাফিকের।