গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস মালিকরা বায়ারদের নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্ট করতে না পেরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে করে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন শিল্পমালিকরা। মালিকরা আশঙ্কা করছেন, সংকট অব্যাহত থাকলে নারায়ণগঞ্জে অনেক গার্মেন্টস লোকসানের কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১১৫১টি গার্মেন্টস রয়েছে। স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিল ২১টি। টেক্সটাইল ৪৩৮টি। ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং কারখানা ১১৬টি। এক্সেসরিজ তৈরির কারখানা ১২০টি। জেলায় সব ধরনের মোট কারখানার সংখ্যা ৪২২১টি। এছাড়াও হোসিয়ারি ২৪৮০টি, টেক্সটাইল ৩০টি, নিটিং ৫৬টিসহ সর্বমোট ২ হাজার ৭২১টি অরেজিস্ট্রিকৃত কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লাতেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস কারখানা। বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ধুঁকছে রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত এই গার্মেন্টস শিল্প।
ইপিলিয়ন গ্রুপের শ্রমিক হৃদয় জানান, আগে আমরা নির্ধারিত সময় কাজ করেও ওভারটাইম করে অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করতে পারতাম। গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যার কারণে এখন ওভারটাইম তো দূরের কথা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কাজ করতে পারি না। আগে দৈনিক ৫শ থেকে ৬শ টাকা আয় হতো এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দরের জাহিন নিট ওয়্যার অ্যান্ড ডাইংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল উদ্দিন বলেন, গ্যাসের ব্যবহার বেশি হচ্ছে ডাইংয়ে। গার্মেন্টসে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি। বর্তমানে গ্যাস বিদ্যুতের সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি অর্ডারও কমে যাচ্ছে। বর্তমানে লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের কাজের পরিধিও কমে গেছে। আগে আমরা ওভারটাইম করাতে পারতাম। এখন ওভারটাইমও প্রায় বন্ধ। শ্রমিকদের আয়ও আগের তুলনায় কমেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে সময় মতো শিপমেন্ট দিতে পারছি না।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের যে বিষয়টি এটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। এই সমস্যা নিরসনে হয়তো একটু সময় লাগবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করলে এটা সমাধান করতে পারবে। বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পের পরিবেশ অশান্ত করতে আন্তর্জাতিক নানা ইন্ধন আছে। এগুলো মোকাবিলা করে এগুতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে।
ইউনিটি নিট কম্পোজিটের জিএম (ডাইং) রাজীব আহাম্মেদ বলেন, কখনো কখনো এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, গ্যাস একেবারেই থাকে না জিরো পিএসআই থাকে। তখন ডাইং ফিনিশিং কিছুই চলে না। শুধু গ্যাসই নয় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়েরও মারাত্মক অবস্থা। এক ঘণ্টা থাকলে আরেক ঘণ্টা থাকে না। আমাদের গ্যাসের বিলও দিতে হচ্ছে বিদ্যুতের বিলও দিতে হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, মেশিনে রং দেওয়া হয়েছে কিন্তু তখন যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে মেশিন শাটডাউন হয়ে পুরো রংটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন সেটা ঠিক করতে ডাবল কস্ট লাগে। গার্মেন্টসগুলো কোনোরকম চললেও ডাইংগুলো গ্যাস বিদ্যুৎ না থাকলে চালানো অসম্ভব। এক্সপোর্ট সাধারণত একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে করতে হয়। করতে না পারলে গার্মেন্টসগুলো ডিসকাউন্ট খাচ্ছে। আমরা বেতন দিতে পারছি না। ওভারটাইম দিতে পারছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে সেটা ভেবে পাচ্ছি না।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে গ্যাস বিদ্যুৎ নিয়ে চরম সংকটে রয়েছি। বিগত সরকারের আমলে যখন গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি করা হলো তখন কথা ছিল আমাদেরকে আনইন্টারেপ্টেড পর্যাপ্ত গ্যাস দিবে। এজন্যই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু সত্য হলো আমরা বর্ধিত দামেও পর্যাপ্ত গ্যাস পাইনি। বর্তমানে কোন কোন এলাকায় তো গ্যাস একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণেও আমরা অনেক সমস্যায় ভুগছি। বর্তমান সরকারকে আমরা বলেছি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধান করতে। গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। কোন কোন স্থানে উৎপাদন ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত কমেছে। অঞ্চলভেদে গ্যাসের সংকট রয়েছে যার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বেশি। সাভারের ওই সাইডটাও ভুক্তভোগী। দেখা যায়, আমাদের এক্সপোর্টের একটা টাইম লিমিটেশন রয়েছে। টাইম লিমিটেশনে শিপমেন্ট ফেল করলে যেটা হয় বায়ার আমাদের কাছে হয় ডিসকাউন্ট দাবি করে নয়তো এয়ার শিপমেন্ট করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে এটা হলো ইনস্ট্যান্ট ক্ষতি। আর লংটার্ম যে ক্ষতি সেটা হচ্ছে যে, বায়ার আমার উপর আস্থা হারানোর পর আমাকে আর অর্ডার দিবে না। তখন সে হয়তো বাংলাদেশেই অন্য কারো কাছে যাবে নয়তো দেশের বাইরে অন্য কোথাও যাবে।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, আমরা যে কয়েকটা সমস্যা চিহ্নিত করেছি তার মধ্যে ১নং কারণ হচ্ছে গ্যাস বিদ্যুতের সংকট। এটা নিয়ে যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা যায় তাহলে হয়তো ইমিডিয়েট সমাধান পেতে পারি, যদিও এটা সমাধানে লংটার্ম সময় লাগবে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনে সরবরাহ করা হলে গ্যাস সংকটের সমাধান কিছুটা হতে পারে।
তিনি বলেন, আমি হতবাক গত সরকারের সময় শুনেছিলাম আমরা বিদ্যুৎ সারপ্লাস উৎপাদন। তাহলে সেই বিদ্যুৎ গেল কোথায়? এটা কি কোনো সাবোটাজ কিনা এটা দেখার বিষয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ কিন্তু কনটিনিউয়াস থাকছে না। অথচ তেলের দাম আগে যেখানে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছিল সেটা ৭০ ডলারে নেমে এসেছে। এতে উৎপাদন খরচ কমার কথা। আগে ক্যাপাসিটি চার্জ নামে বিদ্যুৎ না নিয়েও অনেক বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এই টাকা কিন্তু জনগণের টাকা। এখানে জনগণের বিপুল পরিমাণ টাকা অপচয় হয়েছে। আমরা যদি গ্যাস বিদ্যুৎ না থাকার কারণে শিপমেন্ট করতে না পারি, রপ্তানি করতে না পারি- তাহলে বেতন দিবো কিভাবে। গার্মেন্টস শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হলে দ্রুত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধান করা জরুরি।