খেলাধুলা

সাকিবের চেয়ে ক্রিকেট বড়

‘এমন দিন সাকিব আল হাসানকে দেখতে হতো কি না, সেটা বিরাট প্রশ্নের। এর সব দায়ভার সাকিবকেই নিতে হবে। কেন সে রাজনীতিতে গেলো? তার কীসের কমতি ছিল’, বলছিলেন জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক। 

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এক পরিচালক রীতিমতো বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘সাকিব বাংলাদেশে এসে খেলতে পারছে না, এর থেকে বড় শকিং খবর আর কী হতে পারে? এর জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কি কোনোভাবে দায়ী? এর জন্য কেবল সাকিবই নিজেকে দোষারোপ করবে।’ 

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে পারছেন না? যে মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ‘সাকিব’ ‘সাকিব’ ধ্বনিতে উন্মাতাল থাকত, সেই গেটের সামনে চোখে পড়ে, ‘নো এট্রি ফর সাকিব’। সঙ্গে আরো কত কিছু—‘ফ্যাসিস্ট সাকিব’, ‘স্বৈরাচার সাকিব’, ‘জুয়ার দালাল সাকিব।’ 

যে মাঠে পা মাড়িয়ে দেশের সাকিব থেকে বিশ্বসেরা সাকিব হয়েছেন, সেখানে তাকে খেলতে না দিতে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বরাবর দেওয়া হয়েছে স্মারকলিপি। তাতে স্পষ্ট করে লিখা, ‘সাকিব আল হাসানকে জাতীয় দল থেকে বাদ দিন এবং সাকিবের অপকর্মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আপনার (বিসিবি) জায়গা থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রত্যাশা। নয়ত, আমাদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আরো কঠোর করে তুলব।’ 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলে জার্সি তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এজন্য দেশে ফিরে আসা এবং প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাওয়ার শর্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু, বিগত পতিত সরকারের সংসদ সদস্য সাকিবের দেশে আসার সিদ্ধান্ত ঝুলে ছিল সরকারের সবুজ সংকেতের ওপর। তার নামে হত্যা মামলা হয়েছে। শেয়ারবাজারে কারসাজির কারণে করা হয়েছে জরিমানা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একেবারেই বিরুদ্ধে ছিল সাকিবের। 

তবুও কিছুটা আশ্বাস পাওয়ায় সাকিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে রওনা হয়ে দুবাই চলে এসেছিলেন। কিন্তু, সেখানে আবার তাকে বার্তা পাঠানো হয়, ‘এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। দেশে আসা ঠিক হবে না।’  এই বার্তা দেওয়া হয় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বড় কারণও আছে, এমনটাই বিশ্বস্ত সূত্র বলছে। 

প্রথমত, দেশের ক্রিকেট এখন সাকিবের চেয়ে অনেক বড়, অনেক বিশাল। সাকিবকে এক ম্যাচের জন্য খেলতে আসতে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার এবং বিসিবি। বিদেশি দলগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়া সরকার এবং বিসিবির প্রধানতম দায়িত্ব। সাকিবের জন্য বিসিবি যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিল, তা যে যথেষ্ট নয়, তা এরইমধ্যে বুঝে গিয়েছে। 

সাকিবকে আক্রমণ করতে গিয়ে ভুলবশত বাংলাদেশ বা দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ বা তাদের বহরে আক্রমণ করলে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য চরম দুঃসংবাদ হবে। নিরাপত্তা ইস্যুতে তাই কোনো ছাড় দিতে রাজি হচ্ছে না বিসিবি। এজন্য সাকিবকে ছাড়াই দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আতিথেয়তা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আয়োজকরা।

জানিয়ে রাখা ভালো, এই সিরিজের আগে এমনিতেই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সফরের জন্য সবুজ সংকেত দেয়। 

দ্বিতীয়ত,  সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার, তা বলতে দ্বিধা করেন না কেউ। কিন্তু, রাজনৈতিক কারণে সাকিবের এই পরিণতির চিন্তাও করতে হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্কাকে। সাকিব কিংবদন্তি বলেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন, যা ইচ্ছে তা করতে পারবেন, এমন উদাহরণ তৈরি করতে নারাজ বিসিবি। আগের তিন মেয়াদে নাজমুল হাসান পাপনকে স্রেফ এলোমেলো করে দিয়েছেন সাকিব। যখন যা ইচ্ছে করেছেন সাকিব। সবচেয়ে বড় বিষয়, খেলা চলাকালীন রাজনীতিতে মাঠে নেমেছেন বিসিবির চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড় হয়েও। রাজনীতিতে নেমে বিসিবিকে তার প্রয়োজন হয়নি। এখন দুঃসময়ে সাকিবের পাশেও একই অবস্থানে বিসিবি। খেলোয়াড়দের জন্য বিসিবির ক্যানভাস অনেক বিশাল বড়। তাকে দিয়ে বাকিদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করার পক্ষপাতি নয় বিসিবি।

তৃতীয়ত, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে বিগত সরকারের পতন হয়েছে। তারা ‘বাছাই’ করে দেশকে পরিচালনা করতে নিজেদের প্রতিনিধি সর্বস্তরে বসিয়েছে। বিসিবিতেও তাই। ফারুক আহমেদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে পরিচালক নির্বাচক হওয়ার পর এখন বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। ছাত্র-জনতা সাকিবের দেশে ফেরা ও বাংলাদেশ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ কোনোভাবেই মানতে পারছে না। তাদের প্রতিনিধি হয়ে আসা ফারুক আহমেদকে তাই সেই সিদ্ধান্তকে মানতে হচ্ছে। এছাড়া, এই আন্দোলন আরো তীব্র হলে, যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সরকার এবং বিসিবির ওপর চাপ বাড়বে। এসব কিছু বিবেচনাতেই সাকিব দেশে আসার অনুমতি পাননি।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি নিজেও চেয়েছি, সাকিব আল হাসানের মতো একজন ক্রিকেটার দেশের মাটিতে অবসর নিক। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, প্রথম দিকেই বলেছি, সাকিব আল হাসানের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে, যা স্বাভাবিক। রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করাসহ জনমনের ক্ষোভ নিরসনে তিনি ফেসবুক পোস্ট দিলেও সাম্প্রতিক প্রতিবাদে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তা যথেষ্ট ছিল না। যারা প্রতিবাদ করছে, তাদেরও তা করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। সাউথ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের মধ্যকার সিরিজে কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতেই আপাতত দেশে খেলতে আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে বিসিবিকে পরামর্শ দিতে হয়েছে। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার আশু ব্যবস্থা হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে, সকলেরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত বলে মনে করি। কোনো অভিযোগ থাকলে আইনি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়েই তার সমাধান খোঁজা যেতে পারে।’

আইসিসির বোর্ড সভায় অংশ নিতে ফারুক আহমেদ এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। সাকিবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। তবে, কথা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি সবটাই সাকিবকে জানিয়েছেন তিনি। সাকিবও নিজের অবস্থান, দেশের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আপাতত দেশে আসার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর বাংলাদেশ দল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করবে। সেখানে খেলতে বাধা নেই সাকিবের। এমনকি আগামী বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও খেলতে পারেন। 

দেশে ফেরার সুযোগ না পাওয়ায় সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ার কানপুরেই সমাপ্ত হয়েছে। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার থেমেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ২০২৫ সালে পাকিস্তানে থেমে যেতে পারে ওয়ানডে ক্যারিয়ার।