ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ ‘সচল নদীর মতো সংগ্রামী জীবন’ শিরোনামে মতিয়া চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানানো লেখায় লিখেছেন, ‘২০২৪ সালে এসে আমরা ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান দেখলাম, সেখানে সেই সময়ের মতিয়া চৌধুরীকে দেখেছি একদম নিষ্প্রভ, নীরব এবং পেছনে লুকানো। আমার মনে হয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণের এই ন্যায়সংগত বিক্ষোভের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা ঠিক নয়।’ কারণ, রাজনীতি তার কাছে কোনো বিনিয়োগ ছিল না, ছিল জনসেবা। আর তাই ‘ঠক বাছতে গা উজাড়’-রাজনীতির দেশে, আন্দোলনের ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে খ্যাত মানুষটি আগুনপাখি হয়ে রইবেন। এক মিথলজিক্যাল পাখি হয়ে রইবেন। তারপরও তাকে নিয়ে সমালোচনা হবে। অন্তত নীরব না থাকলে পারতেন। কেন থাকলেন সে উত্তর জানার সুযোগ নেই। তবে সাম্প্রতিককালে মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে যে বিতর্ক এই প্রজন্মের মনে কিছুটা হলেও আক্রোশ জাগিয়ে তুলেছে তার পেছনের কারণ কী?
পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোই আধুনিক বিশ্বের গতিশীলতার মেরুদণ্ড। এই কাঠামোর আওতা থেকে পুরুষও যে মুক্ত নয়, আকাদেমিয়ায় কিছুটা বিচরণ করলেই বোঝা যায়। তবে ভারি কথা না-ই বা হোক। সরল বাক্যে এই পুরুষতান্ত্রিক মেরুদণ্ডের সমাজ নারীকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছে যে সচেতন মানুষমাত্রই তা চিহ্নিত করতে পারবেন এমন নয়। নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিয়ে কথা কম হয়নি। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপটে তা হয়ে উঠেছে জটিল, সংকটপূর্ণ এবং দ্বান্দ্বিকতার ছলনায় পরিপূর্ণ। আজও অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্কুচিত নারীর ক্ষমতায়ন। নারীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে শিক্ষাগ্রহণের অধিকার অর্থাৎ নারী সাক্ষর হতে পারে এখন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এখনও নারীর গোপন সংগ্রাম আমাদের হৃদয় পর্যন্ত আসতে পারে না। কারণ আমরা খালি চোখে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর কারণে তা বুঝতে পারি না।
বিশেষত একবিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বেই। অথচ বিশ্বের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন নারীরাই করেছে। সেই ১৯৭০ সালে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে উইম্যান স্ট্রাইকস ডে যা আজও অনেক নারীকে আন্দোলনের সূত্র দেয়। আর সম্প্রতি যেমন ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ এপার-ওপার বাংলায় তুমুল আলোড়ন জাগালো সেও তো সেই ১৯৭৭ সালে লন্ডনে সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সাহসী নারীদের সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা।
এমন ঐতিহ্যবাহী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় থাকা নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ আশাজাগানিয়া নয়। এর পেছনের কারণ সমাজতাত্বিক বিশ্লেষণে সহজ হলেও নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন বিষয়টির নিশ্চিত মীমাংসা দেখায় না। তাই আজও নারীকে নানাক্ষেত্রে লাঞ্ছনা, গঞ্জনার শিকার হতে হয়। এখনও নারীর অগ্রযাত্রা বিষয়ে সভা-সেমিনারে নানা আলোচনা হয়। নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। আর সে ক্ষমতায়ন হতে পারে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। কারণ, রাজনীতিই দেশ-রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যেমন আরও অনেক নারীকে রাজনৈতিক মঞ্চে পদার্পণের অনুপ্রেরণা জোগায়, তেমনি সমাজ ও পরিবারেও কন্যাসন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। সেজন্যই রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ জরুরি। শুধু নারী অধিকারই নয়, রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রের অগ্রগতির পথটিও মসৃণ হয়। স্বাধীনতার পূর্বের অর্ধদশক ও পরবর্তী সময় দেশের রাজনীতিতে প্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন মতিয়া চৌধুরী।
৮২ বছরের জীবৎদশায় তিনি যে আদর্শ এবং দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তা নারীর অগ্রযাত্রায় অনুকরণীয়। মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল বামপন্থী রাজনীতির মাধ্যমে। ইডেন কলেজে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৬০–এর দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়, তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আইয়ুব খানের আমলে চারবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে তার চিন্তা ও মনের পরিবর্তন হয়েছে। আর হয়েছে বলেই বামপন্থী রাজনীতি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। এরপর দলটির হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন সামরিক সরকারের সময় কারাবরণ করেছেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, মন্ত্রীত্বও করেছেন।
রাজনীতিতে যখন ক্ষমতা, লোভ ও ভয়ের অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যখন অনেক ত্যাগী রাজনীতিবিদও তাদের আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি, তখনও মতিয়া চৌধুরী ছিলেন নিজের বিশ্বাসে অটল। রাজনীতিকে তিনি প্রাপ্তির সিঁড়ি করেননি। রাজনীতিতে তার উপস্থিতি নারীর অংশগ্রহণের জন্যও উদ্দীপক। রাজনীতিতে নারীর অংশগহণকে তিনি চমক হিসেবে দেখাননি। বরং তার অবিচলতা, ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা সমাজের পিছিয়ে থাকা নারীর জন্য বরাবরই অনুপ্রেরণার।
আজকে আমরা যখন লিঙ্গ সমতার কথা বলি, সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথা বলি, তখনও বিশ্বজুড়েই রয়েছে লিঙ্গবৈষম্য। একটি সমীক্ষা বলছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও নারীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে দেখতে রাজি নয়। এই যদি হয় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা, তাহলে আমাদের অবস্থা যে তথৈবচ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে আমাদের নারীদের অগ্রযাত্রার পথে যে অর্জন, তাতে মতিয়া চৌধুরীর মতো নেতার উপস্থিতি ছিল আশা জাগানিয়া। যা শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো উপমহাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্যও ইতিবাচক। এ অঞ্চলের মানুষ নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে আন্তরিক। ফলে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখানে কখনোই বড় বাধা হয়নি। এ অঞ্চলে লিঙ্গবৈষম্য থাকলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাতে নারী প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির উদাহরণ আছে। সংখ্যা বিচারেও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং শীর্ষপদে আরোহণে উপমহাদেশের নারীরাই এগিয়ে। সেক্ষেত্রেও মতিয়া চৌধুরী উজ্জ্বল উদাহরণ।
আমাদের রাজনীতিতে নারীর এগিয়ে আসার পথে দৃষ্টান্ত হয়ে রইবেন মতিয়া চৌধুরী। তিনি রাজনীতির মাঠে যেমন, তেমনি জাতীয় সংসদেও অন্যান্য সংসদ সদস্যের মতোই সংসদীয় কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। সমাজ ও দেশের কাজে সক্রিয় হয়েছেন। মেয়েরা শুধু ঘরের কাজ করবে আর মুখ বুজে মেনে নেবে নানা অত্যাচার, এমন পরিস্থিতির যে বদল দরকার তারও দৃষ্টান্ত হতে পারেন তিনি। তার জীবনাদর্শ দেখে আগামীর কিশোরী-তরুণীরা শিখবে নারীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার পক্ষে সরব হওয়া ও নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার পথটি। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যে শুধু রাজনৈতিক চমক না, তা বোঝার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সামনেও অন্যন্য উদাহরণ মতিয়া চৌধুরী।