শীতকালীন আগাম সবজি চাষে অধিক লাভের আশায় মানিকগঞ্জের কৃষকেরা সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনুকূল আবহাওয়ায় উত্তম পরিচর্যায় বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা থাকায় আগামজাতের সবজি চাষে ঝুঁকছেন জেলার কৃষকেরা। বাম্পার ফলন আর বাজারদর ভালো থাকলে আগাম সবজিতে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন তারা।
সবজি চাষে সুনাম রয়েছে রাজধানীর পাশের জেলা মানিকগঞ্জের। অনুকূল আবহাওয়া আর উত্তম পরিচর্যার কারণে এখানে ফলনও ভালো হয়। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় এখানকার উৎপাদিত সবজিগুলো চাহিদাও রয়েছে অনেক। কৃষিপণ্য বাজারজাত করণেও কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচও কম লাগে। সবমিলে সবজি চাষে লাভবান জেলার কৃষকরা। ফলে আগামজাতসহ রবি মৌসুমের সবজির আবাদ দিন দিন বাড়ছে।
জেলার সাতটি উপজেলায় কম বেশি সবজির আবাদ হলেও সিংগাইর সাটুরিয়া ও মানিকগঞ্জ সদরে সবচেয়ে বেশি সবজির আবাদ করা হয়। সারা বছরই বাণিজ্যিকভাবে নানান জাতের সবজি চাষ করেন এসব এলাকার কৃষকেরা। কম খরচে বেশি লাভের আশায় শীতকালীন আগাম সবজি চাষের ধুম চলে এসব এলাকার কৃষক পরিবারগুলোতে।
জেলার বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে শোভা পাচ্ছে শীতকালীন আগাম জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, বেগুন, মূলা, করলা, পটল, লাল ও পালং শাক, শসাসহ বিভিন্ন জাতের সবজি। ভোর থেকে কৃষকেরা ফসলের খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত।
সরেজমিনে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ফুকুরহাটি ইউনিয়নের চামারখাই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ভোর থেকে সবজি খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষকেরা। কেউ ফুলকপি খেতে কাজ করছে আবার কেউ করলা খেতে কীটনাশক দিচ্ছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সূত্রে জানা গেছে, গত রবি মৌসুমে জেলায় ৯ হাজার ৩৯২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজির আবাদ করেছিল কৃষকেরা। এ বছর সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমি। গত বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে সবজির আবাদ কমেছে ১০ হেক্টর। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে সবজির।
আগাম সবজি চাষ নিয়ে কৃষক মজিবর রহমান বলেন, গত বছর আগাম ফুলকপি চাষ করে সব খরচ বাদে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। এ বছরও ১৮ বিঘা জমিতে এক লাখ পাঁচ হাজার আগাম ফুলকপির চারা রোপণ করেছি। এখন পর্যন্ত সাত লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ফুলকপির ফলন তুলতে পারবো। আশা করছি, অনুকূল আবহাওয়া থাকলে বাম্পার ফলন হবে। তবে বাজারদর ভালো পেলে প্রতিপিচ ফুলকপি পাইকারী দরে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বিক্রি হলে এবছর ৩৫ লাখ টাকার ফুলকপি বিক্রি করতে পারবো। এতে খরচ বাদে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা থাকবে।
এই উপজেলার কৃষক বশির আহমেদ বলেন, গত বছর ১৬ বিঘা জমিতে আগাম ফুলকপি চাষ করতে খরচ হয়েছিল ৬-৭ লাখ টাকা। আর বিক্রি করেছিলাম ২৫ লাখ টাকা। তাতে খরচ বাদে বেশ লাভ হয়েছিল। এ জন্য এ বছর ৩০ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করার টার্গেট আছে। ইতোমধ্যে ১২ বিঘা জমিতে আগাম ফুলকপি চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত আমার ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
তিনি বলেন, টানা বৃষ্টিতে ফুলকপির চারার কিছুটা ক্ষতি হয়েছে এবং ছত্রাকের সংক্রমণে পাতাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পরে কৃষি অফিসের সহায়তায় এই সমস্যার সমাধান হয়েছে। আগাম ফুলকপি আবাদ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ আবহাওয়া খারাপ হলেই ফলন ভালো হয় না। আবার বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের বিষয় আছে। তবে আশা করছি এবার সম্পন্ন ফুলকপির ফলন ঘরে তুলতে পারলে ৩৫ লাখ টাকা আয় করতে পারবো।
কৃষক আবদুল হালিম বলেন, প্রতি বছরই সবজি আবাদ করি। এ বছর ৫ বিঘা জমিতে নানা ধরনের সবজির চাষ করেছি। দুই বিঘা ফুলকপি, এক বিঘায় শসা আর বাকি দুই বিঘায় করলা ও মুলা চাষ করেছি। এতে আমার দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। শসা, মুলা আর করলা মিলে ৫০ হাজার টাকার মত সবজি বাজারে বিক্রি করেছি। তবে আগাম ফুলকপি ১০ থেকে ১২ দিন পর বিক্রি করতে পারবো। আশা করছি এ বছরও সবজিতে লাভ হবে।
সাটুরিয়া উপজেলার হরগজ গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, এবছর ফুলকপি, লাউ, লাল শাক ও সিমের আবাদ করেছি ৬ বিঘা জমিতে। গত বছর ফুলকপিতে বেশ লাভ হয়েছিল। অন্যসব সবজিতে লাভ হইছে কিছুটা কম। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। পাইকারী বাজারের লালশাক, লাউ ও সিম বিক্রি করেছি ৪০ হাজার টাকার মত। এবছরও জিনিসপত্রে দাম অনেক বেশি, আশা করছি বাজারদর ভালো থাকলে আগাম সবজি চাষে বেশ লাভ হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক ড. বরীআহ নূর আহমেদ বলেন, গত বছর মানিকগঞ্জে ৯ হাজার ৩৯২ হেক্টর জমিতে নানা জাতের সবজি আবাদ করেছিল কৃষকেরা। তবে এবছর আবাদি জমি পরিমাণ ১০ হেক্টর কমে ৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষকরা আগাম জাতের সবজি আবাদ শুরু করেছে। কিছু সবজি স্থানীয় বাজারসহ পাইকারি বাজারেও বিক্রি শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে টানা বৃষ্টিতে ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে অনুকূল আবহাওয়ায় ফলন ভালো ও বাজারে সবজির দরদাম ভালো থাকলে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে কৃষকেরা এবছরও লাভবান হবে। কৃষি অফিস থেকে প্রান্তিক কৃষকদের সবসময় নানা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি চলতি মৌসুমে সবজির ভালো দাম পাবে কৃষকেরা।