সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আলোচনা, ক্ষেত্র বিশেষে সমালোচনার শেষ হচ্ছে না। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে প্রায় ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় থেকেছেন। তাকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আর যে কয়দিন খেলবেন, আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই থাকবেন।
সাকিবকে নিয়ে সর্বশেষ আলোচনা, দেশের মাটিতে তার বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ খেলতে না পারা নিয়ে। তিনি ভারতের মাটিতে দেশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ঘোষণা দেন, তার টেস্ট ক্যারিয়ার আর লম্বা করতে চান না এবং শেষ টেস্ট ম্যাচ দেশের মাটিতে সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে চান। একজন খেলোয়াড়ের এ চাওয়া খুবই সঙ্গত এবং আবেগী। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই চাওয়া পূরণ হয়নি। ভারতের মাটিতে তাকে জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলতে হয়েছে।
সাকিব তার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের পাশাপাশি বেশ কয়েক বছর নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্ববের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সম্ভবত, তখন তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। শেখ হাসিনা তখন তাকে পরবর্তী ২০১৯ সালের ওয়ান ডে বিশ্বকাপে মনোযোগী হতে পরামর্শ দেন। তবে, ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে থাকা মাশরাফি বিন মুর্জতাকে শেখ হাসিনা গ্রিন সিগন্যান দেন এবং তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপে সাকিব দুর্দান্ত খেলেন এবং যে রেকর্ড গড়েন, তা অনন্য। ৮ ম্যাচে ৮৬ দশমিক ৫৭ গড়ে ৬০৬ রান তোলার পাশাপাশি ৩৬ দশমিক ২৭ গড়ে ১১ উইকেট নেন। বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটার এই অর্জনের ধারে-কাছে তো নেই-ই, বিশ্বের মাত্র চারজন খেলোয়াড় এক বিশ্বকাপে ৬০০ রান করতে পেরেছেন।
সেবার শেখ হাসিনা সাকিবের সরাসরি রাজনীতিতে আসা থামাতে পারলেও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তা আর পারেননি। মাগুরা-১ সংসদীয় আসন থেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বসিয়ে সাকিবকে মনোনয়ন দেন এবং ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনায়াসে জয়ী হয়ে সাকিব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি একইসঙ্গে রাজনীতি এবং ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি এখন সবচেয়ে সমালোচিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশে কোনো খেলোয়াড় খেলোয়াড়ি জীবনের পাশাপাশি সংসদ সদস্য হতে বা থাকতে পারেন, আইনত বা নৈতিকভাবে এতে বাধা নেই। কিন্তু প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, খেলার মধ্যে রাজনীতিকীকরণ নিয়ে। দেশের মানুষ দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে খেলার জয় উদযাপন করেন, পরাজয়ে ব্যথিত হন। তারা আওয়ামী লীগের এমপি মাশরাফি বা সাকিব বাংলাদেশের হয়ে মাঠে খেলছেন, এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিতে পারেন না; বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাইরের মানুষেরা। দেশের সব মানুষ চান, নির্মল বিনোদনের এ জায়গাটা দল-মতের বাইরে থাকুক।
আমাদের দেশের বড় সমস্যা— সবকিছুর রাজনীতিকীকরণ। কোনো ঘরনার বাইরে থেকে স্বাধীনসত্ত্বা নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার নজির দেশে কম। হয়ত এজন্য দেশে এবং দেশের বাইরে আমাদের অর্জনও কম। গত এক যুগে আওয়ামী লীগ সরকার এই রাজনীতিকীকরণে কিছু আর বাদ রাখেনি। এর একটা ছিল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য বানানো। এ কারণে সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা সংসদ সদস্য হয়েছেন। এর সর্বশেষ সংযোজন হলেন সাকিব আল হাসান। এভাবে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের এমপি-মন্ত্রী বানালে স্থানীয় রাজনীতিকদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ত্যাগী ও সৎ নেতারা নিরুৎসাহিত হন।
রাজনীতি খারাপ কিছু নয়। রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার স্বীকৃত কোনো পথও নেই। যে কেউ চাইলে রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু, এরও একটা সময় ও পর্যায় থাকতে হবে। কিছু জায়গা আছে, যেগুলো দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ ‘নিজের’ মনে করে। দেশের ক্রিকেট তেমনই একটি ক্ষেত্র। নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ এবং মাশরাফি বিন মুর্তজা বা সাকিব যে সংস্কৃতির শুরু করে গেছেন, তার থেকে দেশের ক্রিকেট আর কখনও বের হতে পারবে বলে মনে হয় না। এই রাজনীতিকীকরণের কারণে সাকিব দেশে মাটিতে বিদায় নিতে পারলেন না।
বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিব অনেক বড় তারকা। যিনি প্রায় এ দশক ধরে আইসিসি র্যাংঙ্কিকে সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন। এখন সেরা অলরাউন্ডারের স্থান অন্য কোনো দেশের খেলোয়াড় দখল করেছেন, ভবিষ্যতেও হয়ত তারাই থাকবেন। সুদূর ভবিষ্যতেও সেখানে বাংলাদেশের নাম দেখা যাবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। কারণ, সাকিব আল হাসানেরা কালেভদ্রে জন্মান।
প্রত্যেক ক্ষেত্রে একজন আইডল থাকতে হয়। যাকে দেখে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়। সাকিব আল হাসান তেমনই একজন। নতুন প্রজন্মের সবাই সাকিব হতে চান। গুণীকে সম্মান না করতে পারলে গুণীর জন্ম হয় না। একজন গুণী খেলোয়াড়ের শেষ সম্মানটুকু আমরা দিতে পারলাম না।
সাকিবের বেপরোয়া মনোভাব, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, অর্থের প্রতি অতিমোহ- এসব নিয়ে সমালোচনা আছে, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অনেক কিছুতে তার আরও কিছুটা সংযত, বিনয়ী হওয়া উচিত ছিল। তিনি তা পারেননি। তিনি তার আগের কাউকে দেখে শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাননি। দেশের ইতিহাসে এমন বিশ্বখ্যাত সুপার স্টার তিনি ছাড়া আর কেউ আসেননি। আগামীর আর কোনো সুপার স্টার সম্ভবত এমন ভুল করবেন না; কারণ তাদের সামনে একজন সাকিব আল হাসান থাকবেন।
আজ সাকিবকে দেশের মাটিতে খেলতে না দিতে যারা আন্দোলন করেছেন, তারাই একদিন বাংলাদেশে জয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তারাই হয়ত একদিন আরেক সাকিবের জয়ে উল্লাস করবেন। সেই সাকিবকেও কি এভাবে মনোবেদনা নিয়ে বিদায় নিতে হবে? আমরা বড্ড ভুল সংস্কৃতির শুরু করলাম। যে মানুষটা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বে বাংলাদেশকে চেনালেন; দেশের কাছে তিনি কি এই সম্মানটুকু পেতে পারতেন না? ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা কী শেখালাম?
লেখক: সাংবাদিক।