আন্তর্জাতিক

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যেভাবে শুরু

ইরানে শনিবার ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ইরান হামলা প্রতিহতের খবর জানিয়ে বলেছে, খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

২ অক্টোবর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইসরায়েলি হামলা দীর্ঘ প্রত্যাশিত ছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ওই সময় তেহরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ইরান ‘বড় ভুল করেছে।’

ইসরায়েল-ইরানের এই পাল্টাপাল্টি হামলা হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। প্রায় এক বছর আগে ইসরায়েল যখন গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন থেকেই আঞ্চলিক উত্তেজনার বিন্দু প্রসারিত হতে শুরু করে। দুই দেশের সর্বশেষ সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ টাইম লাইন রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

৮ অক্টোবর, ২০২৩: ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর গুলি বিনিময়

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই দিনই গাজায় হামলা চালাতে শুরু করে ইসরায়েল। এর পরের দিন লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তজুড়ে গুলি বিনিময় শুরু করে লেবাননের হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে এখনো পর্যন্ত ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত এবং দুই শতাধিক বন্দি হয়। গাজার যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

৮ অক্টোবর হিজবুল্লাহ জানায়, তারা ফিলিস্তিনিদের সাথে ‘সংহতি প্রকাশ করে’ সীমান্ত অঞ্চলে শেবা ফার্মের তিনটি সামরিক পোস্টে গাইডেড রকেট এবং আর্টিলারি হামলা চালিয়েছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এই শেবা ফার্ম লেবাননের কাছ থেকে দখল করেছিল

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, তারা লেবাননের একটি এলাকায় ফের গোলা নিক্ষেপ করেছে। সেখান থেকে ইসরায়েল সীমান্তে মর্টার দিয়ে গোলা ছোড়া হয়েছিল।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে গুলি বিনিময় অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর চলতি বছরের ৬  সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বাহিনীর মধ্যে সাত হাজার ৮৪৫টি হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে। এর প্রায় ৮২ শতাংশ ইসরায়েলি বাহিনী চালিয়েছে।

পহেলা এপ্রিল, ২০২৪:  ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালায়

ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ধ্বংস হয়ে যায়। এ ঘটনায় আইআরজিসি (ইরানের বিপ্লবী বাহিনী) কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার ডেপুটিসহ ১৩ জন নিহত হয়।

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তবে এই হামলাটি প্রথমবারের মতো কূটনৈতিক চত্বরকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে। ইরান হামলাার জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

১৩ এপ্রিল, ২০২৪: ইসরায়েলে ইরানের হামলা

সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে মারাত্মক হামলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহায়তায় দেশের সীমানার বাইরে আটকানো হয়েছিল। জর্ডান তার আকাশসীমা অতিক্রমকারী কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতেও সাহায্য করেছিল। 

ইসরায়েলের একটি সাত বছর বয়সী কন্যা শিশু ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো বিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, অন্যরা সামান্য আহত হয়েছিল। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে ইরানের বিমান হামলা পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল।

৩১ জুলাই, ২০২৪: ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা

হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ ইরানের রাজধানী তেহরানে ৩১ জুলাই ভোররাতে নিহত হন। তিনি যে ভবনে অবস্থান করছিলেন সেখানে একটি বিমান হামলা হয়। হামাস ও ইরান এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। এর আগের দিন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তেহরানে গিয়েছিলেন হানিয়াহ। এ ঘটনায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘কঠোর শাস্তির’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

২৩-২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪: ইসরায়েল লেবাননে সাত শতাধিক মানুষকে হত্যা করে

২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর প্রায় এক হাজার ৬০০ লক্ষ্যবস্তুতে ৬৫০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। দক্ষিণে বিনতে জেবিল এবং আইতারউন থেকে উত্তরে বেকা উপত্যকার বালবেক পর্যন্ত এসব হামলা চালানো হয়।

২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র চারদিনে ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননজুড়ে পরিচালিত বিমান হামলায় সাত শতাধিক মানুষ নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৫০ জন শিশু ও ৯৪ জন নারী রয়েছে। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহও এই হামলায় নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করা হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, বৈরুতের একটি আবাসিক শহরতলিতে ৮৫টি তথাকথিত ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ব্যবহার করেছে। আবাসিক এলাকা এবং অন্যান্য জনবহুল এলাকায় এই ধরনের বোমার ব্যবহার জেনেভা কনভেনশনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২৪ সেপ্টেম্বর, হিজবুল্লাহ হাইফার দক্ষিণে ইসরায়েলের অ্যাটলিট নৌ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ড্রোন দিয়ে বিমান হামলার প্রতিশোধ নেয়।

২ অক্টোবর: ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

ইরান জানায়, তারা হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর শীর্ষ নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা ইসরায়েলে ওপর প্রায়অ ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। তেহরান দাবি করে, তারা প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। এরপর থেকে ইসরায়েলের মিত্ররা তেল আবিবকে প্রতিক্রিয়া সীমিত করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা বা তেল স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার পক্ষে নন। 

বিরোধ কিভাবে বেড়েছে?

 বৈরুতের লেবানিজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডেনিজাল জেজিক আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটন এবং এর প্রক্সিরা ইসরায়েলকে যেকোনো ধরনের জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করছে এবং নিশ্চিত করছে যে নেতানিয়াহু গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যেতে পারে, পুরো অঞ্চলে ঔপনিবেশিক সহিংসতা চালিয়ে যেতে পারে এবং যে কেউ হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে তাকে মোকাবিলা করতে পারে।’

তিনি জানান, বিশেষ করে মার্কিন আধিপত্য এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায় গণহত্যায় হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

জেজিক বলেন, ‘ইসরায়েলি সরকার এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে তার কোনো চূড়ান্ত সীমা রেখা নেই... (তারা) সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে কারণ তারা সেটি পারে।’