দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হয়।
পুঁজিবাজারে সংস্কারের উদ্যোগে নতুন আশায় স্বপ্ন বুনতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হতে চললেও বাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি। বরং দিনের পর দিন যে সংকট রয়েছে, তা আরও ঘনীভূত হতে চলেছে।
এতে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে সূচক। ফলে এমন পরিস্থিতিতে শূন্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও। পুঁজি হারিয়ে ‘নিঃস্ব’ হয়ে বাজার ছাড়তে শুরু করেছেন অনেক বিনিয়োগকারী।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের অর্থ সম্পাদক মো. সাজ্জাদুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন অব্যাহত রয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্বপ্রায়।’
বাজার সংশ্লিষ্ট বলছেন, গভীর সংকটে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এমন পরিস্থিতি দেখেও কোনা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুঁজিবাজারের সংকট যেন দেখার কেউ নাই। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজার সংস্কারের লক্ষ্যে তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, বর্তমানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার চলছে। এর মধ্যেই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার আভাস মিলছে। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ধস মেনে নেওয়া যায় না। অর্থনীতির বড় সংকটের মধ্যে থেকেও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তায় শ্রীলঙ্কার পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের পুঁজিবাজার উঠেছে রেকর্ড উচ্চতায়। অথচ দেশের পুঁজিবাজার ধারাবাহিক পতন মুখে হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রোববার (২৭ অক্টোবর) ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে, যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে গত ১৯ আগস্ট বিএসইসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
এ দিন দেশের পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৫ পয়েন্টে। আর ২৭ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে। ফলে এ দুই মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৮১০ পয়েন্টে।
ফলে তার যোগদানের দুই মাসের বেশি অতিবাহিত হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা না বেড়ে উল্টো আরও কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক ভারী হচ্ছে।
এদিকে রোববার সকাল থেকেই উভয় পুঁজিবাজারে দরপতন দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূচকের পতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স পতন হয় ১৪৯ পয়েন্ট। পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতনের প্রতিবাদে এদিন দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পুরনো ভবনের সামনে সামনে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বিনিয়োগকারীরা।
এ সময় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার পতন রোধে তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে বিভিন্ন দাবি পেশ করেন। এ সময় 'বিনিয়োগকারীদের বাঁচাও' বলে আর্তনাদ করেন ‘নিঃস্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত’ বিনিয়োগকারীরা।
ব্রোকারেজ হাউস এসবিএসি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ ইশতিয়াক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘রোববার পুঁজিবাজারে বড় পতন হয়েছে। মার্জিন ঋণ নিয়ে আমার শেয়ার কেনা ছিল। আজকে বড় পতনের ফলে আমার কেনা শেয়ারগুলো দাম পড়ে যায়। এতে ব্রোকারেজ হাউস আমার শেয়ারগুলো জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সড সেল) করে দেয়।
‘আমি একাধিকবার তাদের ফোর্সড সেল না করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে ফোর্সড সেল করা যৌক্তিক নয়। আজকে আমি পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব।’
তিনি বলেন, ‘আমার মতো আজকে হাজারো বিনিয়োগকারী আজকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন। বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষায় নতুন কমিশন ব্যর্থ। তারা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরল এই মার্কেট ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
এদিকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের অর্থ সম্পাদক মো. সাজ্জাদুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন অব্যাহত রয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্বপ্রায়।
‘এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষায় প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার সংস্কারে নানান ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আমরা আলোচনা করছি। কীভাবে সংকট দ্রুত কাটানো যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছে।
‘আমরা পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও আলোচনা করব। খুব দ্রুত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেন আস্থা ফিরে আসে সে লক্ষ্যে বিএসইসি কাজ করছে। আশা করছি পুঁজিবাজার শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে।’