শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দিতে আপত্তি নেই জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে সরকার।
তিনি বলেন, “প্রকল্পের কাজ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হোক, এতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। ইউজিসির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সেনাবাহিনীকে কাজ দিতে চায়, এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো সমস্যা নেই।”
“সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়ার জন্য আমরা সহযোগিতা করব,” বলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পের চলমান কার্যক্রম সেনাবহিনীর কাছে হস্তান্তরসহ পাঁচ দফা দাবির প্রেক্ষিতে তা বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনার বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদেরর সঙ্গে বৈঠক বসেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন তিনি।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা জায়গাটা আমি দেখিনি। তবে এটা একটা বিরাট জায়গা ও মহাপরিকল্পনা। এটাকে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা মহাপ্রকল্প বলা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগে আমি বুঝতে পারি, জমি অধিগ্রহণ কেন হয়নি; প্রকল্প পরিচালকের দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত করে দেখে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হোক। বর্তমান প্রকল্প বুয়েটের মাধ্যমে চলছে, এটি এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’
শিক্ষা উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আন্দোলনের আগে আমি অনেক কিছু করে দিয়েছি। প্রথম ফেজের (ধাপ) মেয়াদ বাড়িয়েছি, একনেক সভায় এ মহাপরিকল্পনার অনুমোদনও দিয়ে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের ছোটখাটো যে দাবিগুলো রয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই সমাধান করতে পারে।’
এদিকে, দাবি পূরণে শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একমত হওয়ায় চলমান পাঁচ দফা আন্দোলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া তিনদিনের আল্টিমেটাম ও আন্দোলন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন জবি শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার জবির দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পের চলমান কার্যক্রমের নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ও তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধির বৈঠক শেষে অন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংগঠক এ কে এম রাকিব।
আন্দোলনের সংগঠক এ কে এম রাকিব বলেন, ‘আমাদের দাবিদাওয়া পূরণ ও মন্ত্রণালয় আমাদের সঙ্গে একমত হওয়ায় আমরা ঘোষিত আল্টিমেটাম থেকে সরে আসছি। আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইউজিসি বরাবর প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চিঠি প্রদান করবে। প্রকল্প পরিচালকের পদে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। আর প্রকল্পের প্রথম ধাপের বাকি পাঁচটি কাজ সেনাবাহিনী করবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদের কাজের ডিপিপি হলে সেটাও সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানো হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিমসহ শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, আন্দোলনের মুখপাত্র তৌসিব মাহমুদ সোহান প্রমুখ।
গত ৩ নভেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে তা সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরসহ তিন দফা দাবিতে ৪ নভেম্বর থেকে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ি ৪ নভেম্বর দুপুরে তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ অবরোধে আটকা পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম।
ওই সময় উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটা এমন না যে, বললেই কাজ হয়ে যাবে। যা ১২ বছরে হয়নি, সেটা ১২ দিনে সম্ভব না। আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলছি, এটাও একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে।’
পরে উপাচার্য গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে তাঁতিবাজার থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনার জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ডাকা হলে. তারা তা প্রত্যাখান করে স্লোগান দিতে থাকেন।
পরদিন ৫ নভেম্বর দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলনে নেমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ করে দেন।
গত ৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান ও অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি সুবিধা দেওয়ার জন্য অর্থ সংস্থান নিশ্চিত করতে হায়ার অ্যাডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে ইউজিসি। এ প্রস্তাবনার অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সোমবার (১১ নভেম্বর) সকালে পাঁচ দফা দাবিতে গণপদযাত্রা নিয়ে শিক্ষা ভবনের সামনে এসে অবস্থান নেন জবি শিক্ষার্থীরা। বিকেলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম তিন কর্মদিবসের মধ্যে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্প সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার আশ্বাস দেন এবং মঙ্গলবার দুপুরে উপচার্যসহ দুজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিয়ে পাঁচ দফা রোডম্যাপসহ আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ আশ্বাস পেয়ে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ক্যাম্পাসে ফেরেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা পাঁচ দাবি আদায়ে অনঢ় অবস্থান নেন। দাবিগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি হলো- স্বৈরাচারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ প্রকল্প পরিচালককে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সাতদিনের মধ্যে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সেনাবাহিনীর দক্ষ অফিসার নিয়োগ করতে হবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসতে হবে- সেনাবাহিনীর হাতে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ হস্তান্তর করা হয়েছে এবং হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে হবে (অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হল)।
বাকি তিন দাবি হলো- অবিলম্বে বাকি ১১ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পুরাতন ক্যাম্পাস নিয়ে স্বৈরাচার আমলে করা সব অনৈতিক চুক্তি বাতিল করতে হবে, সম্প্রতি ইউজিসির ঘোষণাকৃত পাইলট প্রকল্পে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক বাজেট সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে।