আমেরিকান প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউস। একজন প্রেসিডেন্ট সপরিবারে এই ভবনে বসবাস করেন। কিন্তু তারা এই ভবনের একটি জানালা খোলারও অনুমতি পান না। যে কারণে, কোনো কোনো প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসকে বন্দিশালা হিসেব আখ্যা দিয়েছেন।
ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউতে হোয়াইট হাউসের অবস্থান। এই ভবনের নকশা করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের নাগরিক জেমস হোভান। আটাশ একর জায়গার উপর নির্মিত এই ভবনের আয়তন ৫৫ হাজার বর্গফুট। ছয় তলা বিশিষ্ট হোয়াইট হাউস ১৩২টি রুম, ৩৫টি বাথরুম, ৪১২ টি দরজা, ১৪৭ টি জানালা, ৮৮টি ফায়ারপ্লেস, ৮ টি সিঁড়ি ও ৩টি লিফট রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ১২ লাখ পর্যটক হোয়াইট হাউস দেখতে আসেন।
জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৯১ সালে হোয়াইট হাউসের মূল নকশা অনুমোদন করেন
হোয়াইট হাউস পৃথিবীর বিখ্যাত ভবনগুলোর একটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৯১ সালে হোয়াইট হাউসের মূল নকশা অনুমোদন করেন। ১৭৯২ সালের অক্টোবরে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। হোয়াইট হাউস নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই ১৭৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর ফলে তিনি এই ভবনে বসবাসের সুযোগ পাননি।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন এডামস ১৮০০ সালে যখন সপরিবারে হোয়াইট হাউসে বসবাস শুরু করেন তখনো ভবনটি নির্মাণাধীন অবস্থায় ছিলো। হোয়াইট হাউস নির্মাণ করতে সে সময় প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার ৩৭২ ডলার খরচ হয়েছিলো৷ বর্তমানে এই ভবনটির মূল্য দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার সমান।
১৮১৪ সালে ব্রিটিশরা আসল হোয়াইট হাউস পুড়িয়ে দেয়
১৮১৪ সালে মার্কিন বাহিনী কানাডার পার্লামেন্টে আগুন দেওয়ার পর ব্রিটিশরা আসল হোয়াইট হাউস পুড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে ভবনটি বহুবার পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। প্রথম থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বসবাসের এই হাউজের নাম হোয়াইট হাউস ছিল না। এমনকি তখন এর রঙও ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন সময়ে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। সেসব নামের মধ্যে এক্সিকিউটিভ ম্যানশন এবং প্রেসিডেন্ট প্যালেস নাম দুটি বেশি ব্যবহৃত হতো। ১৯০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ তম প্রসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই ভবনের নাম রাখেন হোয়াইট হাউস।
ইস্ট উইং-এর একাংশ
হোয়াইট হাউজ বলতে আমরা শুধু একটি ভবনকেই বুঝি কিন্তু হোয়াইট হাউজ মূলত তিনটি ভবনের সম্মিলিত নাম। মূল বাসভবন ছাড়াও এর আরো দুইটা অংশ রয়েছে। একটি অংশের নাম ওয়েস্ট উইং এবং আরেকটি নাম ইস্ট উইং। দুই তলা বিশিষ্ট ইস্ট উইংয়ে বেশ কিছু অফিস এবং ফার্স্ট লেডি বা প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর কর্মচারীর রুম রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা এদিক দিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন। মূল বাসভবনের দুইটি প্রবেশপথ রয়েছে। দক্ষিণ দিকের অংশ দিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথিরা হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন। মূল ভবনটি প্রধানত ৬ তলা। উপরের দুই তলায় রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার বসবাস করে। এবং মাঝের দুই তলায় রান্নাঘর, ডাইনিং হল, লাইব্রেরী, ডাক্তারের চেম্বার, গোয়েন্দা সংস্থার অফিস, এমনকি একটি বোলিং খেলার কোর্টও আছে। নিচের দুই তলায় লন্ড্রি, স্টোর রুম ও রক্ষণাবেক্ষণ এর কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম রাখা আছে।
হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং হলো সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। তিন তলা বিশিষ্ট অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের অফিস রয়েছে। ওয়েস্ট উইং এর একটি কক্ষের নাম সিচুয়েশন রুম। এই রুম থেকে প্রেসিডেন্ট পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারে। ওয়েস্ট উইং এর ওভাল অফিস হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর প্রধান কার্যালয়। একজন প্রেসিডেন্ট এখানেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটান। এছাড়াও হোয়াইট হাউসের ওয়েস্টইংয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট রুম, কেবিনেট রুম, সামরিক প্রদানের রুম সহ আরো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে।
হোয়াইট হাউস নিঃসন্দেহে আমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গাগুলোর একটি। হোয়াইট হাউসের চারপাশে ১২০০ জন সেনা সব সময় টহলরত অবস্থায় থাকেন। এছাড়াও সার্বক্ষণিক নজরদারের জন্য রয়েছে নাইট ফিশন ক্যামেরা, উন্নত প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা ড্রোন।
পারমাণবিক হামলার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে হোয়াইট হাউসের কমপক্ষে ১০০০ ফুট মাটির নিচে দুইটি বাংকার রয়েছে। এসব বাংকারে দীর্ঘদিন বসবাস করার মত রসদ, শোবার ঘর, টয়লেট আছে। প্রেসিডেন্ট যেন অফিস করতে পারে এবং পেন্টাগনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে সেটিরও সুব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। হোয়াইট হাউসের নিচ দিয়ে বহু সুরঙ্গ পথ রয়েছে যা ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে উন্মুক্ত হয়েছে। তাছাড়া এই ভবনে রয়েছে থিয়েটার, জিম, ফুলের দোকান, এবং চকলেট এর দোকান।
অতীতে ভবনের ভেতরে একটি ইনডোর সুইমিং পুল ছিল। সেই সুইমিং পুলের জায়গাটিকে বর্তমানে প্রেস ব্রিফিং রুমে রূপান্তর করা হয়েছে। পরবর্তীতে ভবনের বাইরে ওয়েস্ট উইং এর পাশে একটি আউটডোর সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয়। হোয়াইট হাউসের আঙিনা জুড়ে বাহারি ফুলের বাগান রয়েছে। এই ভবনে বসবাসকারী সব প্রেসিডেন্টের অভিজ্ঞতা সমান নয়। বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট একে ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হোয়াইট হাউসের নাম দিয়েছিলেন চাকচিক্যপূর্ণ বন্দিশালা, কারণ এখানকার বাসিন্দারা আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেও, তাদের নিজেদের ঘরের জানালা খোলার অনুমতি নেই। আরেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এটিকে পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে তুলনা করেন। মজার ব্যাপার হলো মার্কিন প্রেসিডেন্টেরা এখানে যে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন তার সবকিছু বিনামূল্যে দেওয়া হয় না। প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারের খাবারের খরচ মাসে শেষে পরিশোধ করতে হয়। টুথপেস্ট কেনা থেকে শুরু করে জামা কাপড় পরিষ্কার করার মতো বিভিন্ন খরচ প্রেসিডেন্টকে নিজেকেই বহন করতে হয়।
হোয়াইট হাউসের সবুজ চত্বর
হোয়াইট হাউসকে আক্ষরিক অর্থে হোয়াইট করে তুলতে প্রচুর পরিমাণে সাদা রং লাগে। হোয়াইট হাউস রং করতে পারায় ২২০০ লিটার সাদা রং ব্যবহার করা হয়। রং করা ছাড়াও হোয়াইট হাউস রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর প্রায় ৭ থেকে ১৪ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়ে থাকে। শীতকালের তুষার পাতের কারণে হোয়াইট হাউসের সবুজ চত্বর সাদা রং ধারণ করে।
হোয়াইট হাউসের ভেতরে রয়েছে অসাধারণ সব আসবাবপত্র। নতুন প্রেসিডেন্টের আগমনের সাথে সাথে তাদের রুচি অনুযায়ী আসবাবপত্রের পরিবর্তন করা হয়। তবে হোয়াইট হাউসের সবচেয়ে ঐতিহাসিক এবং উল্লেখযোগ্য ফার্নিচার হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেস্ক। ওক কাঠের তৈরি এই টেবিল। ১৮৮০ সালে বৃটেনের রানি ভিক্টোরিয়া আমেরিকার ১৯তম প্রেসিডেন্ট রাদারফোর্ড বি হেইজ টেবিলটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।