মওলানা ভাসানীর চীন সফর পরবর্তী সংবর্ধনাকে ঘিরে একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। সেদিনও ভাসানীর মাথায় ছিল তালপাতার টুপী, পরনে লুঙ্গি। তার বেশভূষা দেখে শ্রোতাদের মধ্যে গুনগুন মন্তব্য- ‘ইয়ে তো মিসকিন হ্যায়’! কোরান তেলাওয়াত দিয়ে ভাসানী বক্তব্য শুরু করতেই সেই শ্রোতারা বলল- ‘ইয়ে তো মাওলানা হ্যায়’!
রাজনৈতিক বক্তব্য শুনে তারা এবার অবাক হয়ে পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন- ‘আরি বাহ্ ইয়ে তো পলিটিশিয়ান হ্যায়!’ যখন ভাসানী বিশ্ব মোড়লদের শোষণ নিপীড়ন সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন তখন ঐ একই দর্শকশ্রোতা বলে উঠলেন- ‘হায় আল্লাহ, ইয়ে তো এস্টেট মেন হ্যায়!’ কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়:
‘‘দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু, যেন মহাপ্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি উত্তরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তার বিচর্ণিত দক্ষিণ বাংলার শবাকীর্ণ হু হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের দৃশ্যাবলীময়, শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার।’’ (সফেদ পাঞ্জাবী/শা.রা.)
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার গঠিত ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতির’র মাধ্যমে কি প্রচলিত ধারণার ইসলমি খেলাফত চেয়েছেন? নাকি ইসলামি সমাজতন্ত্র চেয়েছেন? তার রাজনৈতিক পরিভাষাগুলোর আমাদের অনেক শিক্ষিত ইতিহাসবিদদের কাছে অবোধ্য-দুর্বোধ্য। আমরা তার তিনটি রাজনৈতিক পরিভাষার ব্যাখ্যার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক দর্শনকে বুঝার চেষ্টা করব। রুবুবিয়াৎ, খুদায়ে খিদমাতগার এবং হুকুমতে রাব্বানিয়া।
রুবুবিয়াৎ বা পালনবাদ: কুরআনের অনুবাদ করতে গিয়ে অধিকাংশ অনুবাদক ‘রব’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘প্রভু’। যা ইসলামী দৃষ্টিতে শিরক বা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার করা। মওলানা ভাসানী সচেতনভাবে এর অনুবাদ করেছেন ‘পালনবাদ’। একজন পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহ সবাইকে খাওয়ান, পরান, আলো বাতাস দেন। জীবজন্তুকে খাওয়ানোরও দায়িত্ব নেন। কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষকে আমি (আল্লাহ) খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছি। (২:৩০) এই খলিফা ইসলামি খেলাফত বা রাজতন্ত্রের খলিফা না। কারণ, খেলাফত ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের খলিফা হন একজন। আর রুবুবিয়াতের খলিফা আমি, আপনি, সবাই। আমরা সবাই আল্লাহর প্রতিনিধি। সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর যা যা দায়িত্ব, আমাদের ওপর তাই দায়িত্ব। এটা যে ভাসানীর মনগড়া ব্যাখ্যা, বিষয়টা এমন না। তার ব্যাখ্যার পেছনে কুরআনে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। পবিত্র কুরআনের অন্য জায়গায় মানুষকে আল্লাহর রঙে রঙিন হতে বলা হয়েছে। (২:১৩৮)
মওলানা ভাসানীর হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি থেকে প্রকাশিত ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া: পূর্বশর্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধে লেখক শামসুল হক বলেন, ‘‘আল্লাহর সমস্ত গুণাবলী মানবজীবনে রূপায়িত হলে কতই না সুন্দর হবে। ...রব হিসেবে এই সৃষ্টিকে পালন অর্থাৎ রুবুবিয়াতের কাজ করাই আল্লার সবচাইতে বড় কাজ। আল্লার খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মানুষেরও প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে রুবুবিয়াৎ পালন।’’
রুবুবিয়াতের চারটি স্তর- বিয়ের আগে, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে, সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে।
খুদায়ে খিদমাতগার: ছান্দসিক কবি আবদুল কাদিরের লেখা ‘মানবসেবা’ কবিতার মাধ্যমে আমরা এই অপরিচিত পরিভাষার একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানোর চেষ্টা করব– ‘‘হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান। মানুষ বলিবে– তুমি প্রভু করতার, আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার? বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে, তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।’’
আমরা আরও স্পষ্ট হয়ে যাব বাচা খান প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন ‘খুদায়ে খিদমাতগার’-এর শপথ বাক্যগুলোর দিকে যদি তাকাই। শপথ বাক্যের অংশবিশেষ- ‘আমি পালনকর্তার একজন দাস, এবং পালনকর্তার কোনো সেবার প্রয়োজন নেই, সৃষ্টির সেবা করা হচ্ছে তাঁর সেবা করা। আমি পালনকর্তার নামে মানবতার সেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি সহিংসতা এবং প্রতিশোধ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি ভালো আচার-আচরণের অনুশীলন করব। অলস জীবনযাপন করব না। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা সামাজিক কাজে দেব। আমি আমার জাতি ও জনগণের স্বাধীনতার জন্য আমার সম্পদ, জীবন এবং স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করব। আমি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, নিপীড়িতদের পাশে থাকবে। আমি অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের সদস্য হবো না, সেনাবাহিনীতেও দাঁড়াব না। আমি অহিংসার জীবনযাপন করব। আমার উদ্দেশ্য আমার দেশ এবং আমার ধর্মের স্বাধীনতা অর্জন। আমার সেবার জন্য আমি কোনো পুরস্কার চাই না। আমার সমস্ত প্রচেষ্টা আমার পালনকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, প্রদর্শন বা লাভের জন্য নয়।’
ভাসানী কেনো টাঙ্গেইলে সে সময় পশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলেন? কারণ তিনি পালনবাদী, সর্বপ্রাণবাদী। খুদায়ে খেদমতগারের একজন অনুসারীর পক্ষে নদী দূষণ, বৃক্ষ নিধন সম্ভন নয়। এটাকে কি সুফিবাদী আন্দোলন বলা যায়? কিন্তু সুফিবাদ তো এমন না! যদিও এই আন্দোলনে সুফিবাদের একটা ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়। এর অনুসারীদের অনেকেই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অসাম্প্রদায়িক সুফি আন্দোলন রোশানী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। গান্ধীও অংশ নিয়েছেন এতে। বাচা খান ও গান্ধীর আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে অংশ নেওয়ার ছবিও পাওয়া যায়।
হুকুমতে রাব্বানিয়া: হুকুমত শব্দের অর্থ আদেশ। কুরআনে এসেছে, ‘সৃষ্টি যার, আমর বা আইন তার’ (৭:৫৪)। কিন্তু হুকুমতে রাব্বানিয়ায় ‘আমর’ বা ‘আইন’ বলতে হুবহু কুরআনিক আইন বুঝায় না বরং আইনের পাশাপাশি এর সংস্কারও বুঝায়। ভাসানীর দীক্ষাগুরু মওলানা আজাদ সুবহানী তাঁর ‘রব্বানী বিপ্লব : কর্মনীতি প্রয়োগবিধি’ নিবন্ধে বলেন, ‘ধর্মকে নূতন দীপ্তিতে পেশ করিতে হইবে। ...সংস্কারের পদ সৃষ্টি করিতে হইবে যাহার অধিকার থাকিবে মতবাদের (রাব্বানী বিপ্লবের) পুনুরুজ্জীবনের।’
আজাদ সোবহানীর রূপরেখায় একটি পর্টির চিত্ররূপ অন্তর্নিহিত আছে। কিন্তু ভাসানী শেষ জীবনে পার্টির সেন্ট্রালাইজড রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণার প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাই তিনি পার্টি না করে ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি’ গঠন করেন।
হুকুমতে রাব্বানীয়া কি শুধুই মুসলিমদের জন্য? এর জবাবে মওলানা বলেন, ‘শিক্ষাদীক্ষা, খাওয়াপরা ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান, ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই, মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি ভেদাভেদ নাই, ঠিক তেমনি হুকুমতে রাব্বানিয়ার সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে।’ (মাওলানা ভাসানীর রচনা, পলল প্রকাশনী)
ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে মৃত্যুর পর সম্পত্তির মালিক হন মৃতের সন্তান এবং আত্মীয়স্বজন। যেখানে পুত্র ও কন্যার পরিমাণ আলাদা। প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, রাষ্ট্র নয়। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। ভাসানী কোনটি কেন গ্রহণ করেছেন তা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি যখন হুকুমতে রাব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতিবিদরাই এর বিরোধিতা করেন না। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থী এক শ্রেণীর আলেম ওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পত্তির মালিকানা একমাত্র আল্লার। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। আল্লার নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে, কিন্তু তাহাদের মতে ইহা আল্লার নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম ওলামারা সবকিছুতে আল্লার মালিকানা মানিয়ে লইয়া থাকেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না।’ (প্রগুক্ত)
দেওবন্দের ইংরেজবিরোধী চেতনার মধ্যে বেড়ে উঠা মওলানা ভাসানী তার সমগ্র জীবনে ছিলেন রাজনীতি সচেতন। আসামের লাইনপ্রথার বিরুদ্ধাচারণ, কাগমারী সম্মেলন, বিশ্ব শান্তি সম্মেলন, বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন, কিউবা হাভানায় সংহতি সম্মেলন, নিরস্ত্রীকরণ ও মৈত্রী কংগ্রেস লন্ডন, মিশর, চীন, সিরিয়া সফরের মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ধ্রুবতারার মতো পথ দেখায় আমাদের। রাষ্ট্রভাষা উর্দু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ধর্ম আর ভাষা এই দুইটা এক জিনিস না। উর্দু ভাষার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই। আরব দেশের মানুষ কি উর্দুতে কথা বলে?’ মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানা ছিলেন বৃদ্ধ। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব এবং মুসলিম দেশগুলোর প্রধানদের কাছে বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য চিঠি লেখেন। চীন ও আমেরিকাতেও টেলিগ্রাম করেন। ৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভাসানীর সভাপতিত্বে কলকতায় আ.লীগ, ন্যাপসহ ৫ দলের যে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয় তার সভাপতিও ছিলেন ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ভারত থেকে ফিরেই তিনি যে দাবিটি তোলেন তা হলো বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে ফারাক্কা লং মার্চে গিয়ে তিনি যে অসুস্থ হলেন আর সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন না আমাদের মাঝে। ফিরে এলে হয়ত আজকের পানিবণ্টন নীতি অন্য রকম হতো।
ভাসানী ইতিহাসের রাজনীতিকরণের শিকার। ফ্যাসিবাদীদের কাল্ট নির্মাণের জন্যই তাকে মাটিস্থ করা হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে বিভ্রান্ত এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে। আমরা এমন প্রত্যাশা করছি, নতুন কারিকুলামে তাকে সঠিক মূল্যায়ন করা হবে।
সহায়ক গ্রন্থ: ১। হক-কথা সমগ্র- মওলানা ভাসানী ২। মাওলানা ভাসানীর রচনা, পলল প্রকাশনী ৩। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতি : মাওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব- সিরাজ উদ্দিন সাথী ৪। মওলানা ভাসানী: কাছে থেকে দেখা-সৈয়দ ইরফানুল বারী ৫। তাযকিরায়ে মুহাম্মদী-আল্লামা আজাদ সুবহানী ৬। উম্মুল কুরআন-মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
অনার্য মুর্শিদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা