স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল আব্দুল গণির। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে মাথায় গুলি লেগে নিহত হন আব্দুল গণি। এরপর তার সংসারে নেমে এসেছে শোক আর দারিদ্রের কালো ছায়া।
নিহতের স্ত্রী লাকী আক্তারের আকুতি, ‘‘স্বামী হত্যার বিচার কার কাছে চাইব? বিচার চাই না; সংসার বাঁচাতে এখন ছেলের একটা চাকরি চাই।’’
আব্দুল গণি রাজবাড়ী সদর উপজেলার রহিমপুর গ্রামের মজিদ শেখের ছেলে। রাজধানীর গুলশান-২ এলাকায় আবাসিক হোটেল ‘সিক্সসিজন’-এ কাজ করতেন। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বাড্ডার ভাড়া বাসা থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে তিনি গুলিতে নিহত হন।
লাকী আক্তার জানান, ১৫ বছর ধরে সিক্সসিজন হোটেলে চাকরি করতেন আব্দুল গণি। থাকতেন বাড্ডায় একটি ভাড়া বাসায়। ছেলে আলামিন এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় চলে যায়। সেখানে সে ‘শেফ’ এর কাজ শিখছিল।
সম্প্রতি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের চরখানখানাপুর এলাকায় বাড়ি করেন গণি। সেখানেই থাকতেন স্ত্রী ও চার বছরের মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে। মাঝেমধ্যে আব্দুল গণি বাড়ি যেতেন। তিনি যা আয় করতেন তাতে সংসারে টানাপড়েন থাকলেও সুখের কমতি ছিল না।
গত ১৯ জুলাই সকালে রাজধানীর গুলশান এলাকায় আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে মাথায় গুলি লেগে মারা যান আব্দুল গণি। ২১ জুলাই রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তার মরদেহ পান স্বজনেরা। ওইদিন রাতেই তাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
আব্দুল গণির বাবা মজিদ শেখ জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে ছেলের সঙ্গে তার ফোনে শেষ কথা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন- আপনার ছেলে কি ঢাকা থাকে? তিনি ‘হ্যাঁ’ বললে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় আপনার ছেলের গুলি লেগেছে। হাসপাতালে আছে। ঢাকায় কেউ থাকলে পাঠিয়ে দেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মজিদ শেখ বলেন, ‘‘আমার আরেক ছেলে ঢাকায় থাকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলি। আমার ছোট ছেলে হাসপাতালে যাওয়ার পরই জানতে পারে গণি আর নেই। ছেলে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে রয়েছি। চার বছর বয়সে আমার নাতনি এতিম হয়ে গেল! তার করুণ মুখের দিকে তাকাতে পারি না।”
লাকী আক্তার বলেন, ‘‘আমার স্বামী খুব সহজ সরল ছিল। কারও সাথে কোনো দিন তার ঝামেলা হয়নি। সে কোনো রাজনীতিও করত না। ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। স্বামীর মৃত্যুতে আমার সুখের সংসার শেষ হয়ে গেল। সংসার চালাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণী হয়ে গেছি। টাকা শোধ করব কীভাবে?’’
‘‘একে স্বামীর মৃত্যু শোক, আরেক দিকে সংসার আর ঋণের চাপে চোখে অন্ধকার দেখছি! সংসারে হাল ধরার মতো কেউ নেই। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই না। সংসার যেন চালাতে পারি এজন্য ছেলের একটা চাকরি চাই। দু’বেলা দু’মুঠো অন্তত খেয়ে যেন বাঁচতে পারি।”
আব্দুল গণির ছেলে আলামিন শেখ জানান, এসএসসি পাশের পর তার বাবা তাকে ঢাকা নিয়ে আসে। এখন তিনি শেফের কাজ শিখছেন। বাবার সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন। আগের রাতে কাজ শেষ করে সকালে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে ছিলেন আলামিন। সকাল ১০টার দিকে তার মা ফোন দিয়ে বলে- তোর বাবার খবর নে। মাথায় গুলি লেগেছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে বাবার মরদেহ দেখতে পান আলামিন।
আলামিন বলেন, “ওইদিন হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয় বাবার লাশ। ২১ জুলাই রোববার ময়নাতদন্তের পর বাবার মরদেহ বুঝে পাই। আমি কাজ শিখছি। বেকার। বাড়িতে মা আর ছোট বোন। বাবাকে হারিয়ে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি।”