ক্যাম্পাস

জাবিতে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বাম সংগঠনের নেতারা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অটোরিকশার ধাক্কায় মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা করিম রাচি নিহতের ঘটনায় বিচার চেয়ে প্রথম বর্ষের (৫৩ ব্যাচ) শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। ওই মিছিলে বাম সংগঠনের নেতারা স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তারা।

বুধবার (২১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে মিছিল শুরুর আগে এ ঘটনা ঘটে। পরে সেখান থেকে বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা সরে গেলে ১১ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসার সামনে যান।

এর আগে, বুধবার সকাল থেকে দিনভর এ নিহতের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে ‘জাহাঙ্গীনগর ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেন ছাত্র ইউনিয়নের জাবি সংসদের (একাংশ) নেতাকর্মীরা। কর্মসূচি চলাকালে ছাত্রফ্রন্টও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে এ আন্দোলন রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে ছাত্র ইউনিয়নের দিনব্যাপী কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষার্থীরা।

মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনব্যাপী ‘জাহাঙ্গীরনগর ব্লকেড’ কর্মসূচি চলাকালে রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চললে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বাম সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দখল ও ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করছেন- এমন অভিযোগেই তোপের মুখে পড়েন জাবি ছাত্রফ্রন্ট নেত্রী সোহাগী সামিয়া ও ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমন। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহীদ মিনারের পাদদেশে সমাবেশ করার এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এ সময় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক সোহাগি সামিয়া ও ইমনকে উদ্দেশ্য করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা এখানে বামদের প্রতিনিধিত্ব করতে আসিনি, আমাদের বান্ধবী হত্যার বিচার চাইতে এসেছি।’

সোহাগি সামিয়া শিক্ষার্থীদের হুশিয়ারি করে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তখন শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘এখানে কোনো সংগঠন আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না। আপনি মাইকে কোনো কথা বলতে পারবেন না।’ এ সময় সোহাগি সামিয়া হ্যান্ড মাইক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন। তখন সোহাগী সামিয়া ও ইমনকে জোর করে আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বলেন, “২০২২ সালে এক শিক্ষার্থী আহত হওয়ায় ক্যাম্পাসে বেপরোয়া অটোরিকশা নিষিদ্ধ করা হয়। পরে বাম সংগঠনগুলোর দাবির মুখে আবার অটোরিকশা চালু হয়। যারা ক্যাম্পাসে অটোরিকশা চালু করেছে, তাদের এ আন্দোলনে দেখতে চায় না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ হত্যার দায় বামপন্থীদের নিতে হবে।”

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদ বলেন, “আমাদের বান্ধবী ৫৩তম আবর্তনের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্রী আফসানা রাচি হত্যার প্রতিবাদে সকাল থেকে ‘জাহাঙ্গীরনগর ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছিলাম। কিন্তু বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এ আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তারা বিভিন্ন প্রস্তাবনা আমাদের সামনে পেশ করতে থাকে। কিন্তু কারো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সম্মত হইনি এবং সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করি। এক পর্যায়ে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন।”

বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য মিছিল আহ্বান করেছিলেন। তারা সারাদিন উপচার্য, ডিন ও প্রক্টর স্যারদের বিরুদ্ধে অশোভন স্লোগান দিচ্ছিলেন। আমরা তো সহপাঠী হত্যার বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছি। এখানে উপাচার্য, প্রক্টর বা ডিনের পদত্যাগ আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”

গত মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) রাত ৯টায় রাচি নিহতের ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে আট দফা দাবি নিয়ে উপাচার্যের বাসার সামনে অবস্থান নেয় বাম সংগঠনগুলো। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবদুর রহমান বাবুলসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রশাসন। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে একদিনের শোক পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওই সময় গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে ‘জাহাঙ্গীরনগর ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেন বামপন্থী নেতারা। কিন্তু বিভাগের আয়োজনে বুধবার দুপুর ২টায় তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাতে বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিচার দাবিতে ১১ দফা দাবি নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে যান শিক্ষার্থীরা। 

এ সব বিষয়ে মার্কেটিং ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রেদোয়ান বলেন, “রিকশা দুর্ঘটনায় বিভাগের ছোটবোনের মৃত্যুকে আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনায় তার পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর দেখি আমাদের বোনের লাশ নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ আন্দোলন শুরু করেছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, আমরা আমাদের বোনের লাশ নিয়ে রাজনীতি করতে দেব না।”

আফসানা করিম (রাচির) সহপাঠী ও মার্কেটিং বিভাগের ৫৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নিরব বলেন, “আমরা আমাদের বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে এখনও শোকাগ্রস্ত। আমাদের বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করিনি।”

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার বিষয়ে ছাত্রফ্রন্ট নেত্রী সোহাগী সামিয়া বলেন, “৫২ ব্যাচের একজন কল দিয়ে আমার কাছে থাকা মাইকটা চেয়েছিল। শহিদ মিনারে গিয়ে আমি মার্কেটিং বিভাগের ৫৩ ব্যাচের সিআরকে খুঁজে পেয়ে মাইকটা বুঝিয়ে দিয়ে আমি তাদের মিছিলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করি। তখন তারা বলে, ‘আপনি ৫১ ব্যাচের মিছিলে থাকতে পারবেন না।’ এরপর তারা সবাই মাথায় সাদা কাপড় বাঁধছিল। তারা হঠাৎ চিৎকার করে বলে, ‘এখানে ছাত্রফ্রন্টের কেউ থাকতে পারবে না।”

তিনি বলেন, “আমি আসলে ওই সময় বলতে চাচ্ছিলাম, আমি এখানে ছাত্রফ্রন্টের হয়ে আসিনি। জাহাঙ্গীরনগরে আন্দোলনে সবাই এভাবেই যুক্ত হয়েছি। কিন্তু পুরো ভিডিও কেউ ছাড়েনি। শুধু আমার কথাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাড়া হয়েছে।”

ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমন বলেন, “শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় আমরাই সর্বপ্রথম মিছিল শুরু করি। আমাদের দাবি আর বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবি একই। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। তবে আমরা তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হই।”

তিনি বলেন, “সেখানে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আমরা সেখান থেকে চলে আসি। আমরা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে এটা সমাধানের চেষ্টা করবো।”