চলতি মৌসুমে আমন ও ব্রি উদ্ভাবিত ধানের বাম্পার ফলন হলেও ধানের রাজ্য খ্যাত রংপুরে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। উৎপাদনের ভরা মৌসুমেও কমছে না চালের দাম। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রকারভেদে চাল কেজি প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা করে বেড়েছে। চালের এই ঊর্ধ্বমুখী দামে নাভিশ্বাস উঠেছে ক্রেতাদের।
আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা বিপাকে পড়েছেন। অপর দিকে অটো রাইস মিলের মালিক ও সিন্ডিকেটদের দুষছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন, চলতি আমন মৌসুমে রংপুর জেলায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯০০ মেট্রিকটন ধান। উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। রংপুর বিভাগের ৮টি জেলায় চাল উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ টনের বেশি। এতে রংপুর বিভাগের চাহিদা পূরণ হয়েও অন্তত ৮ লাখ মেট্রিকটন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।
২০ নভেম্বর রংপুর নগরীর বৃহৎ আড়ৎ মাহিগঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে, পাইকারী দরে সেখানে স্বর্ণা চাল কেজি প্রতি ৫৪-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত মাসে ছিল ৫০-৫২ টাকা। বিআর-২৮ চাল ৬০-৬২ টাকা যা ছিল ৫৭-৫৮ টাকা। ২৯ জাতের চাল ৫৭-৫৮ টাকা যা গত মাসে ছিল পাইকারি দরে ৫৪-৫৫ টাকা।
মোটা চাল কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৯-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চিকন নাজিরকাটা কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৭০ টাকা ও বাসমতি প্রকার ভেদে পাইকারিতে ৫-৮ টাকা বেড়ে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা পাইকারদের দাবি, আড়ৎদাররা হাজার হাজার মেট্রিকটন চাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চালের বাজার অস্থির করে তুলেছেন। যার প্রভাব লেগে থাকে খুচরা ও পাইকারি বাজারে।
অন্যদিকে খুচরা বাজারে গত মাসের চেয়ে চলতি সপ্তাহে প্রকার ভেদে সব ধরনের চালে কেজিতে বেড়েছে ৪-৫ টাকা করে। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেশের বৃহৎ আড়ৎদার ও মিল মালিকদের সিন্ডিকেটসহ সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থাকে দুষছেন চাল ব্যবসায়ীরা। এদিকে দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।
মাহিগঞ্জ বাজারে চাল কিনতে আসা ঝালমুড়ি বিক্রেতা আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘‘সারাদিন ঝালমুড়ি বেচে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা আয় হয়। বাজার করতে গেলে হা-হুতাশ করি। পাঁচ সদস্যের সংসারে দৈনিক চাল লাগে দুই কেজি। চিকন ২৮ ধানের চাল কিনি প্রতিদিন। আজও কিনেছি কিন্তু চালের দাম বেশি, কেজি ৬৪ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও অনেক বেশি। এ বিষয়ে সরকারেরও কোনো তদারকি নেই!”
আদি রংপুরের মাহিগঞ্জ পাইকারি চাল আড়ৎদার মেসার্স চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ফারুক হোসেন জানান, নতুন ধানের চাল এখনো পুরোদমে বাজারে আসেনি। এলে হয়তো দাম কিছুটা কমতে পারে। তবে নিজেদের দায় অস্বীকার করে বড় বড় মিল মালিকদের প্রতি দায় চাপালেন ফারুক। একই সাথে গত এক মাসের ব্যবধানে পুরাতন চালে কেজি প্রতি ৪-৫ টাকা বেড়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
মেসার্স শহিদুল্লাহ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী চাল আড়ৎদার তুহীন মিয়া বলেন, “আড়ৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো সিন্ডিকেট নেই। সিন্ডিকেট করতে কোটি কোটি টাকার চাল মজুত করতে হয়। সেটি চলে গেছে অটো রাইস মিল ব্যবসায়ীদের হাতে। রংপুরে চাহিদার তুলনায় বেশি ধান উৎপাদন হলেও এর প্রক্রিয়াজাতকরণের মিল ব্যবস্থা এখানে নেই বলে দাম কিছুটা বেশি। বড় বড় চালের মিল দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জসহ দক্ষিণ অঞ্চলে। যার ফলে সেখান থেকেই চালের বাজারগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ছাড়াও কৃষক পর্যায়ে ধান উৎপাদন খরচ এখন আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ফলে ধানের দামও বাড়তি। তাই এর প্রভাব চালেও পড়েছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরে ব্যাপকভাবে ধান উৎপাদন হলেও এই জেলায় ধান প্রক্রিয়াজাতকরণ অটো মিলের সংখ্যা মাত্র ৮ থেকে ১০টি। দিনাজপুরে রয়েছে তিন শতাধিক। নওগাঁ-সিরাজগঞ্জেও শতাধিকের উপরে অটো রাইস মিল রয়েছে। ফলে এই অঞ্চলের ধান কিনে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ওই সমস্ত মিলে সিন্ডিকেট করে ধান থেকে চাল প্রক্রিয়াজাত করে মজুত করে। এর প্রভাব পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে- এমনটাই দাবি পাইকারি ব্যবসায়ীদের।
রংপুর সুসমা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ অটো রাইস মিলের প্রোডাকশন ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ জানান, চলতি মৌসুমে সরকারি দাম অনুযায়ী ধান কেনা হয়েছে ৩৩ টাকা কেজি দরে। সরকার নির্ধারিত চালের দাম করা হয়েছে ৪৭ টাকা। যা গতবারের চেয়ে একটু বেশি বলে জানান তিনি।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ভরা মৌসুমে সরকার অটো মিলগুলোকে ত্রিমুখী চাপে রাখে। এক- সরকারের নির্ধারিত দামে দ্রুত ধান ক্রয়। দুই- সরকারের বেধে দেওয়া সময়ে নির্ধারিত দামে চাল ক্রয় এবং তিন- বাইরের খোলা বাজারে চালের চাহিদা। এগুলো না সামলাতে পারলে লাইসেন্স বাতিল হওয়ারও সংঙ্কা থাকে। ফলে ধান এবং চালের বড় একটি অংশ সরকারের গোডাউনজাত হয়। এর প্রভাব পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে। এক্ষেত্রে সরকারকেই আন্তরিক হওয়ার পরামর্শের কথা জানান অটো রাইস মিলের এই ম্যানেজার।
অসাধু উপায়ে চাল মজুত করার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এই মিলে প্রতিমাসে ১১ থেকে ১২ টন চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যা প্রতিমাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাইকারি দরে বিক্রয় হয়। কখনো দুই থেকে তিন মাসের জন্য চাল মজুত রাখা হয় না।”
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, “এবার অন্য জেলার চেয়ে রংপুরে আমন ধানের ফলন অসম্ভব ভালো হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিকটন চাল অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে।”