অগ্রহায়নের শুরুতে আমনের ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে নেই স্বস্তি। বেড়েছে দাম, কষ্টে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয়টি বন্যায় ধান চাষে বেশ ক্ষতি হয়েছে। বিষযটিকে চালের দামের ঊর্ধ্বগতির একটি কারণ হিসেবে সরকার ব্যাখ্যা দিলেও খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা বলছেন, ‘‘মজুত সিন্ডিকেট’ই করছে চাল নিয়ে ‘চালবাজি’।”
সবচেয়ে বেশি ধান চাষের জেলাগুলো এবং চাল আমদানির স্থলবন্দরগুলোতে ঘুরে রাইজিংবিডি ডটকমের প্রতিবেদকরা দেখতে পেয়েছেন, চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি নেই। এসব বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলেছে খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক মো. আব্দুস সালামের সঙ্গে।
তিনি বলছেন, টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে মাঝারি ও সরু চালের দাম প্রতি কেজি তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে। তবে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি দুই টাকা পর্যন্ত কমেছে বলেও জানান তিনি।
ধানের দেশ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলে ক্ষেতভরা সোনালি ধানের শীষ আমন মৌসুমে স্বস্তির বার্তা দিয়ে গেলেও, বাস্তবে কৃষিপ্রধান এই জনপদের মানুষ চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
চালের অন্যতম প্রধান মোকাম রয়েছে কুষ্টিয়ার খাজানগরে। যেখান থেকে দেশের প্রতি জেলাতেই কম-বেশি চাল সরবরাহ হয়ে থাকে। সেই কুষ্টিয়ার খুচরা বাজারেও চড়েছে চালের মূল্য। যার প্রভাব পড়েছে প্রান্তিক মানুষের হাঁড়িতে।
কুষ্টিয়ার চাল ব্যবসায়ী শাপলা ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম বলছেন, “খাজানগরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আটাশ চালের দাম, যা কেজিতে চার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।”
চাল বিক্রেতা সুফী আল আসাদ বলেন, “চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছি না। অথচ সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই টাকা করে বেড়েছে। সরকার আমদানি শুল্ক কমালেও চালের দাম কমছে না। উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আইলচারা এলাকার করাত কলের শ্রমিক আমজাদ হোসেন বলেন, “চালের দাম বৃদ্ধিতে সংসার চালানোর খরচে চাপ বেড়েছে।”
ভারত থেকে আমদানির চাল আসে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। বন্দর ঘিরে আশপাশের বাজারে রাইজিংবিডি ডটকমের কথা হয় সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে।
হিলি বন্দর খুচরা বাজারে চাল কিনতে এসেছিলেন এনামুল হক। তিনি বলেন, “এখন ধানের (আমন) মৌসুম। আবার ইন্ডিয়া থেকে গাড়ি গাড়ি চাল আমদানি হচ্ছে। তারপরও চালের দাম কমছে না কেন? প্রতি বছর এই সময় নতুন ধান উঠলে বাজারে চালের দাম অনেক কমে যায়। কিন্তু এবার বাজারের চিত্র উল্টো।”
হিলি বন্দর দিয়ে ট্রাকে ট্রাকে চাল ঢুকছে দেশে, অথচ বাজারে দাম না কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এনামুল হক।
রংপুরে ‘গরিবের মোটা চাল’ কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৯-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চিকন নাজিরকাটা কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৭০ টাকা ও বাসমতি প্রকার ভেদে পাইকারিতে ৫-৮ টাকা বেড়ে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাইজিংবিডি ডটকমের রংপুর প্রতিনিধি আমিরুল ইসলাম কথা বলেছেন তার এলাকার কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। মোটা চাল কিনতেই হিশমিশ খেতে হচ্ছে তাদের। তার মধ্যে একজন আসাদুল ইসলাম।
ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চলে আসাদুলের। তিনি বলেন, ‘‘সারা দিন ঝালমুড়ি বেচে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা আয় হয়। বাজার করতে গেলে হা-হুতাশ লেগে যায়। পাঁচ সদস্যের সংসারে দৈনিক চাল লাগে দুই কেজি। চিকন ২৮ ধানের চাল কিনি প্রতিদিন। আজও কিনেছি কিন্তু চালের দাম বেশি, কেজি ৬৪ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও অনেক বেশি। এ বিষয়ে সরকারেরও কোনো তদারকি নেই!”
আসাদুলের বিশ্বাস, সরকার যদি ঠিকমতো বাজার মনিটরিং করে, তাহলে চালের দাম এভাবে বাড়তে পারবে না।
রাইজিংবিডির বরিশাল সংবাদদাতা নিকুঞ্জ বালা পলাশ নিজ জেলার চাল ব্যবসায়ীদের কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, চালের দাম বৃদ্ধির কারণ মূলত ‘সিন্ডিকেট’।
বরিশাল চাল আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক আলম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘মিল সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম কমছে না। করোনাকালে বিভিন্ন মিলমালিক ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হন। এ সুযোগে বিভিন্ন কোম্পানি এসব মিল লিজ নেয়। তারা এখন চালের বাজার দর নির্ধারণ করছে।
‘দেশের সব চাল ব্যবসায়ীরা এখন বিভিন্ন কোম্পানির কাছে জিম্মি। এ কারণে বাজারে চালের সরবরাহ থাকা স্বত্বেও দাম কমছে না।’’
আমদানি পরিস্থিতি জানতে ভোমরা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কথা বলেছেন রাইজিংবিডি ডটকমের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শাহীন গোলদার।
ভোমরা কাস্টমস শুল্ক স্টেশন তাকে যে তথ্য দিয়েছে, সে অনুযায়ী, শুল্ককর প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর গত ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৫টি ট্রাকে করে ভারত থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত আমদানিকারকদের মাধ্যমে মোটা সিদ্ধ চাল এসেছে ৩ হাজার ২১৮ মেট্রিকটন। এর মধ্যে শুধু ১৭ নভেম্বর চাল এসেছে ১ হাজার ১৩৯ মেট্রিকটন। প্রতি টন চালের দাম পড়েছে ৪১০ থেকে ৫০০ মার্কিন ডলার।
হিলি স্থলবন্দরে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির দিনাজপুর প্রতিনিধি মোসলেম উদ্দিন। হিলি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম বলেছেন, “শুল্কমুক্তভাবে হিলি বন্দরে ৪১০ ডলারে চাল আমদানি হচ্ছে। গত ১১ নভেম্বর থেকে এক সপ্তাহে ৫ হাজার মেট্রিকটন চাল আমদানি হয়েছে এই বন্দরে।
‘যেহেতু চাল একটি নিত্যপণ্য এবং দেশের বাজারে চাহিদা রয়েছে, সেহেতু কাস্টমসের সকল কার্যক্রম দ্রুত সম্পূর্ণ করে ছাড়করণ করা হচ্ছে।”
ভোমরা ও হিলি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য আশাব্যঞ্জক হলেও ক্রেতা পর্যায়ে দামের ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। ক্রেতাদের মধ্যে চাপা কষ্ট বাড়ছে।
রাইজিংবিডির বগুড়া প্রতিনিধি এনাম আহমেদ তার জেলার খেটে খাওয়া বেশি কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছন। তাদের মধ্যে দু’জন বগুড়া শহরে রিকশাচালক হামেদ আলী এবং রুহুল।
তারা দু’জনেই একই সুরে কথা বলেন। তারা জানাচ্ছেন- তিন বেলা ভাত খেয়েই জীবন যাপন করতে হয়। তারা মোটা চালের ভাত খেয়ে অভ্যস্ত, অথচ সেই মোটা চালই নাগালের মধ্যে নেই। তারা যে চাল খান, সেই চালের মূল্য প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি হলে সেটা তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। বর্তমানে সংসার চালানোই তাদের পক্ষে দায় হয়ে গেছে।
রাইজিংবিডির শেরপুর প্রতিনিধি তারিকুল ইসলাম তার জেলায় অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। যাদের মধ্যে একজন মাছুদুর রহমান, যিনি পেশায় শিক্ষক।
তিনি বলেন, “আমাদের আয় বাড়েনি। সেখানে যদি লাফিয়ে লাফিয়ে চালের দাম বাড়তে থাকে, আমরা সাধারণ মানুষ কীভাবে চলব? একটু ভালো চালের ভাত খাওয়া তো দূরে থাক, মোটা চালও অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।”
দরিদ্র, দিনমজুর ও খেটেখাওয়া মানুষের এই কষ্ট বিবেচনায় নিচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ও। সরকার বলছে, বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এবং চলতি ধানের মৌসুমের ধান পুরোপুরি উঠে গেলে হয়তো চালের দাম কমবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলছিলেন, “মোটা চালের দাম প্রতি কেজিতে সর্বনিম্ন দুই টাকা কমেছে। এটি অবশ্যই সুখবর।”
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বিবেচনা করলে আমাদের দেশে চালের দাম কম। তবে স্থানীয় বাজার বিবেচনায় এই দাম আরও কমানোর বিষয়ে আমরা কাজ করছি।”
আমন মৌসুমেও কেন চালের দাম বাড়ছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, “চালের দাম বাড়ার ‘মাল্টিপল’ (বেশ কিছু) কারণ রয়েছে। এটি চিন্তায় রেখে চালের শুল্ককর কমানো, আমদানির অনুমতিসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে এবং চলতি ধানের মৌসুম শেষে আমরা আশা করছি চালের দাম কমবে।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসানের কাছে রাইজিংবিডি ডটকম জানতে চেয়েছিল, কেন আমন মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে।
জবাবে তিনি বলেন, “শুধু চাল নয়, সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মান ও দাম নিয়ে সরকার কাজ করছে। শুল্ককর তুলে নেওয়ার পর প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিকটন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এসব এলসির বিপরীতে দেশে চাল প্রবেশও করেছে। সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় সহনশীলতা এবং স্থিতিশীলতা উভয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”