রাজশাহীর বাতাসে ক্ষতিকর ভাসমান ধূলিকণা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। অথচ বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ধূলিকণা কমিয়ে ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছিল রাজশাহী। এখন তা উদ্বেগজনক।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে বায়ুর মান পরীক্ষা করে এমন চিত্রই দেখা গেছে। শহরজুড়ে চলমান নির্মাণ কাজের সময় ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ওই সংস্থার গবেষকেরা।
বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নামের সংস্থাটি ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছরই শহরের পাঁচটি স্থানে বায়ুর মান পরীক্ষা করছে। এর ধারাবাহিকতায় শনিবারও নগরের রেলগেট, তালাইমারী, সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, লক্ষ্মীপুর মোড় বিসিক শিল্প এলাকায় বায়ুর মান পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, সহনীয় মাত্রার চেয়ে বায়ুতে ভাসমান ধূলিকণা পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫ এবং পিএম ১০ এখন অনেক বেশি।
সহজ বাংলায় পিএম ১০ ও ২.৫ এর অর্থ হলো- পিএম ১০ বাতাসের সেই সব সূক্ষ্ম ধূলিকণা, যার আকার ১০ মাইক্রোনের চেয়ে কম। আর ২.৫ মাইক্রোনের থেকে ছোট ধূলিকণাকে বলা হয় পিএম ২.৫। প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে পিএম ১০ ও পিএম ২.৫ এর মাত্রা কত তার ওপর বায়ু স্বাস্থ্যকর নাকি দূষিত তা বিবেচনা করা হয়। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২২ এ পিএম ২.৫ এর সহনীয় সর্বোচ্চ মাত্রা ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। আর পিএম ১০ এর সহনীয় মাত্রা ১৫০। রাজশাহীর বাতাসে এই মাত্রা এখন অতিক্রম করেছে।
পরীক্ষায় রেলগেট মোড়ে পি.এম ২.৫ পাওয়া যায় ১২৫ মাইক্রোগ্রাম। আর পি.এম ১০ পাওয়া যায় ১৯০ মাইক্রোগ্রাম। এছাড়া নগরের তালাইমারী মোড়ে পি.এম ২.৫ ও পি.এম ১০ পাওয়া যায় যথাক্রমে ১০৬ ও ১৩০; সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে যথাক্রমে ৭১ এবং ১০৩; লক্ষ্মীপুর মোড়ে যথাক্রমে ৬৮ এবং ৯৩ এবং বিসিক এলাকায় যথাক্রমে ৭৬ এবং ২২২ মাইক্রোগ্রাম। গত বছরের পরীক্ষার সময়ও বাতাসে এই ক্ষতিকর ধূলিকণা ছিল কম।
শনিবার বায়ুর মান পরীক্ষায় নেতৃত্ব দেন প্রকৌশলী জাকির হোসেন খান। তাকে সহযোগিতা করেন অলি আহমেদ, মো. ওবায়দুল্লাহ, শামসুর রাহমান শরীফ, কলি আহমেদ প্রমুখ।
তারা জানান, এবার বায়ু পর্যবেক্ষণে সব স্থানেই অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় পি.এম ২.৫ ও পি.এম ১০ পাওয়া যায়। পি.এম ২.৫ কে বলা ফাইন পার্টিকলেস। এটা ফুসফুসের গভীরে যেতে পারে, এমনকি রক্তের প্রবাহেও যেতে পারে। এর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে।
এদিকে পি.এম ১০ কে বলা হয় কোর্স পার্টিকলেস। এটির জন্য চোখ, নাক ও গলায় অস্বস্তিবোধ হয়। নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক মাত্রায় পি.এম ২.৫ এবং পি.এম ১০ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ন, গাছ কেটে ও পুকুর ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ এবং অবকাঠামো নির্মাণের সময় বায়ু দূষণ বিধি-২০২২ না মানা এই বায়ু দূষণের মূল কারণ। বায়ু দূষণ শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না, এটা জীববৈচিত্র্যের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। তাই এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বলছে, শহরে পর্যাপ্ত এবং পরিকল্পিত গাছ লাগানো উচিত। আম-জাম জাতীয় ফলের গাছ এবং নিম ও সজনে জাতীয় উপকারী গাছ লাগানো যেতে পারে। এগুলো বড় হলে বায়ু দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। সজনে গাছ বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন নির্গমনে কার্যকর গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। একইসঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণে বায়ু দূষণ বিধি মেনে চলতে হবে।
প্রকৌশলী জাকির হোসেন খান বলেন, ‘‘আমরা ২০২২ সাল থেকে বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণার মাত্রা পরিমাপ করছি। ২০২২ এর চেয়ে এবার অনেকটাই বেশি। গতবছর রেলগেট এলাকায় পি.এম ২.৫ ছিল ৯৫ থেকে ৯৬ মাইক্রোগ্রাম। এবার সেটা পেয়েছি ১২০ থেকে ১৩০। এই বৃদ্ধির হারটা কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’’
গবেষক ও পরীক্ষক অলি আহমেদ বলেন, শহরজুড়েই সিটি করপোরেশন নির্মাণ কাজ করছে। কিন্তু বাতাসে ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে তেমন উদ্যোগ নেই। অনেক সময় ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে পানিও ছিটানো হয় না। ফলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহমুদ-উল-ইসলামকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।