সারা বাংলা

রোজা রেখে ইফতারের আগেই গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তাজুল ইসলাম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা তখন উত্তাল। সেই  আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গত ১৮ জুলাই র‌্যাব-পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ওইদিন আশুরা উপলক্ষ্যে রোজা রেখেছিলেন তাজুল ইসলাম। বিকালে তিনি উত্তরার রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসের পাশের একটি মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখেন সংঘর্ষ। মসজিদের মুসল্লি ও আশপাশের মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। এ সময় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি বুলেট তাজুল ইসলামের বুকে এসে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।    তাজুল ইসলামের বয়স ষাটের কোটা ছুঁই ছুঁই। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা উত্তর শিলমুড়ি ইউনিয়নের গামারোয়ায়। তাজুল ওই গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে। তিনি ২০২০ সাল থেকে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের সেনপাড়া (বাইমাকান্দা) গ্রামে জমি কিনে সেখানেই বসবাস করছিলেন। আর সেখানে থেকেই ঢাকার উত্তরায় রেন্ট-এ কারের ব্যবসা করতেন। তবে একসময় তিনি গাড়ি চালিয়ে সংসারের খরচ মেটালেও বার্ধক্যের কারণে একজন চালক রেখেছিলেন। বসতেন রেন্ট-এ কারের অফিসে। সেখানে তিনি একটি পুরনো মাইক্রোবাস কিনে তা ভাড়ায় চালিয়ে সংসারের খরচ মেটাতেন।   পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, অর্থ সংকটের কারণে তাজুলের দুই মেয়ের কেউই এসএসসি পর্যন্ত পড়তে পারেনি। একমাত্র ছেলে রেদোয়ান হোসেন সিয়াম (২০) মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। অভাব অনটনের জন্য লেখাপড়া আর এগোয়নি। তবে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরতে শিখেছেন দর্জির কাজ । দুই বোনের বিয়ে হয়েছে আগেই। বর্তমানে বাবা মারা যাওয়ার পর মা বড় একা হয়ে গেছে। তাই দর্জির কাজ ছেড়ে দিয়ে মায়ের সাথেই সেনপাড়ায় (বাইমাকান্দা) অবস্থান করছেন। লেখাপড়া কম হওয়ায় কোন চাকরির সম্ভাবনাও দেখছেন না তিনি। তাই এখন তিনি দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে জীবন-জীবিকার জন্য হয়তো বিদেশে পাড়ি জমাবেন। সরকারিভাবে ৫ লক্ষ টাকার একটি সহযোগীতা পেয়েছেন। অন্যদিকে, জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশ কালীগঞ্জ শাখার পক্ষে প্রথমে ১ লক্ষ টাকা ও পরে ২ লক্ষ টাকার পৃথক দুটি সহযোগীতা পেয়েছেন। এছাড়াও, দলটির পক্ষ থেকে কিছু খাদ্য সহযোগীতা পেয়েছেন।   রেদোয়ান হোসেন সিয়াম বলেন, “গত ১৮ জুলাই দুপুরে উত্তরার আজমপুরে আমির কমপ্লেক্সের সামনে সংঘর্ষের খবর শুনে বাবাকে মোবাইল ফোনে আমরা রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছিলাম। বাবা ওই সময় জানিয়েছিলো, তিনি অফিসের পাশেই একটি মসজিদের ভেতর অবস্থান করছেন। চালককেও গাড়ি রাস্তায় বের করতে দেননি। সেদিন বাবা আশুরার রোজা ছিলেন। বিকালে ইফতারি নিয়ে বাসায় ফেরার কথা ছিল। বাদ আসর সংঘর্ষের সময় পরিস্থিতি দেখার জন্য রাস্তায় উঁকি মারতেই গুলিবিদ্ধ হন। ইফতার নিয়ে বাবার আর ফেরা হয়নি। মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ দেখতে পাই। আমি যখন হাসপাতালে ছুটে যাই তখন রক্তাক্ত অনেক মানুষের চিৎকার আর আহাজারিতে দিশেহারা হয়ে পড়ি। এ বয়সে এত রক্ত কখনও দেখিনি। গুলিতে আমার বাবার বুকটা ঝাঝরা হয়ে যায়। বুকের ভেতর গুলি রেখেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরদিন বাবাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।”   সিয়াম আরো বলেন, “বাবার মৃত্যুর শোকে মা-ও এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার বাবার তো কোনও অপরাধ ছিল না। তবে তাকে কেন গুলি করে হত্যা করা হলো? কেন আমাকে বাবাহারা করা হলো? এখন কিভাবে চলবে আমাদের সংসার?”   স্বামী তাজুলের ব্যাপারে কথা হয় স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের সাথে। এ সময় তাঁর কন্ঠ ভারী হয়ে যাচ্ছিল, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চোখ। তিনি বলেন, “স্বামী মারা যাওয়ার পর এখন ছেলেটাকেই আকড়ে ধরে আছি। এখন ছেলের কিছু একটা হলেই আমি শান্তিতে মরতে পারবো।” 

এরপর কথা বলার চেষ্টা করেও এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে পারলেন না স্বামী হারা স্ত্রী হোসনে আরা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।   কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এ উপজেলার দুই জন ঢাকার উত্তরায় নিহত হয়েছেন। আমার তাদের তালিকা তৈরি করে গাজীপুর ডিসি অফিসে পাঠিয়েছি। নিহতের পরিবারের সাথে কথা বলে ডিসি অফিস তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বর সংগ্রহ করেছে। চলতি মাসেই হয়তো তারা সহযোগীতা পাবে। এছাড়াও সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবেও সহযোগীতা অব্যাহত থাকবে।”