ক্যাম্পাস

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

গত ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্র্যাটিক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩১২টি ভোট পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।

ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মেরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি করছে। ফলে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে, ক্ষমতার পালাবদলে কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে। এক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় জয়লাভ বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন প্রশ্ন ও সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অপ্রথাগত কৌশল দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও জোরালো প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ইতোমধ্যে বাণিজ্য, কূটনীতি এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ তৈরি করবে।

ট্রাম্প প্রশাসন বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে পূর্বের মতোই কট্টর অবস্থান নিতে পারে। চীনকে মোকাবিলার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি তার নজর আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পাবে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হলে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে বেশি মনোযোগী হতে পারে।

তবে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। ২০১৭ সালে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, যা পুনর্বহাল করা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন পুনরায় ক্ষমতায় এসে যদি এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান ধরে রাখে, তবে বাংলাদেশের রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়া কঠিন হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের বিশেষ আগ্রহ থাকে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবার। ক্ষমতার এই পটপরিবর্তন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল এবং এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের মানবাধিকার ইস্যুতে আগ্রহ কম থাকায় সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার ফলে মানবিক সহায়তা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে, যা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র চীনবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অংশীদারত্ব নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে, তবে বাংলাদেশকে সেক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসননীতি বরাবরই কঠোর ছিল। আবার ক্ষমতায় ফিরে এ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভিসা বিধিনিষেধ এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বাধাগুলো বাংলাদেশি তরুণদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সুযোগ কমিয়ে দিতে পারে।

তবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবদান যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষায় জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের খুব ভালো বৈশ্বিক ইমেজ আছে। ডেমোক্র্যাটদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ড. ইউনূস এখন হোয়াইট হাউজে যে অবাধ স্বাগত ও সমর্থন পান, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে তা নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। গত ৩১ অক্টোবর, এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’’ 

তিনি আরো লিখেন, ‘‘আমরা আপনাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। আমার প্রশাসনের সময় আমরা ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারত্ব আরো জোরদার করব।’’ 

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সম্পর্ক আর এই ইকুয়েশন থেকে ধারণা করা যেতে পারে, বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে পারেন। কারণ, সুযোগ পেলেই ট্রাম্প বিভিন্ন মাধ্যমে জানান দেন যে, ভারত ও নরেন্দ্র মোদি তার ভালো বন্ধু। তবে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিননীতি যে খুব পরিবর্তন হবে তা-ও কিন্তু নয়। এটা অনেক যদি-কিন্তুর ওপর নির্ভর করছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হবেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশও সম্প্রতি সামরিক আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় বা নিরাপত্তা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়তে পারে। তবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহযোগিতা পেতে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যথেষ্ট জাতীয়তাবাদী ধারণা পোষণ করেন। তার লক্ষ্য ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখতে চান। তিনি চান না যুক্তরাষ্ট্র অন্যের জন্য যুদ্ধ করুক। ট্রাম্প অন্যের আইডিওলজি বাস্তবায়নের জন্যও যুদ্ধ করবেন না। ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য মার্কিন অর্থনীতিকে ঠিক রেখে চীনের উত্থান ঠেকানো। রিপাবলিকান দল ও এর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব দেবে। তবে বরাবরের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আধিপত্য ও অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় সমর্থন দিয়ে যাবে এবং ইরানের প্রতি কঠোর হবে। কিন্তু এই মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া বাকি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭০-১৯৮০ এর দশকের মত সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবে, দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক গড়বে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়া ও এরশাদের আমলের মত পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরি হবে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে এসেছে। মুদ্রাস্ফীতি চরম মাত্রা ধারণ করেছে। বেকারত্ব বেড়েছে; নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে এবারের নির্বাচনে। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ‘বেপরোয়া’ জেনেও মার্কিনিরা আবারো তাকে জিতিয়েছেন, এই আশায় যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি তিনি টেনে তুলবেন। বহির্বিশ্বে যুদ্ধে সহযোগিতাকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মত অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প না মেনে নিজ দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্মুখী হবেন তিনি। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। কারণ পরিবেশগত অভিযোজন, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তৃতীয় বিষয়ের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থ সহায়তা আশা করে থাকে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবেশগত চুক্তির প্রতি অনীহা একটি উদ্বেগের বিষয়।

সার্বিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের উচিত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করা এবং একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী করা। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই নয়, চীনের সাথেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি বিবেচনার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণ করা সহজ হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।