গৃহযুদ্ধ শুরুর প্রায় ১৩ বছর পর হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। ১৩ বছরে যেখানে তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটাতে পারেনি সেখানে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে কীভাবে তারা সিরিয়া দখল করলো? এটা নিশ্চিত যে, শক্তিশালী কোনো দেশের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। সেই দেশটি কোনটি তা এখনো স্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি বিদ্রোহীদের কিছু মন্তব্যে ইঙ্গিত মিলেছে তাদের পেছনে ইসরায়েলের মদদ থাকতে পারে।
আসাদকে হটানো বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির নাম হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার দলছুট অংশ। এই গোষ্ঠীর নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি ২০০৩ সালে ইরাকে আল-কায়েদাতে যোগদান করেছিলেন। ২০০৬ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন জুলানি এবং পাঁচ বছর আটক ছিলেন। মুক্তির পর আল-জুলানিকে পরে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
আল-জুলানি ওই সময় আল-কায়েদার শাখা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ইন ইরাকের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির সাথে কাজ করছিলেন। ২০১৩ সালে বাগদাদি হঠাৎ করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন এবং আইএসআইএস প্রতিষ্ঠা করেন। আল-জুলানি আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে এই পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরের বছরগুলোতে আল-জুলানি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ‘বৈশ্বিক খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার আল-কায়েদার প্রকল্প থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। ওই সময় তিনি সিরিয়ার ভেতরে নিজের কার্যক্রম সীমিত করে নেন। সম্প্রতি জুলানি সিএনএনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাতে মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পরিবর্তে তাকে পশ্চিমা ঢঙের প্যান্ট-শার্ট পরা অবস্থায় দেখা গেছে।
নভেম্বরের শেষের দিকে এইচটিএস আলেপ্পো দখল করার পরে তাদের বেশ কয়েক জন কর্মী ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন। ইসরায়েল গাজায় নির্লজ্জ গণহত্যা চালানোর নির্দেশদাতা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর শাসনের প্রশংসা করেছেন তারা।
ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কান সিরিয়ার আলেপ্পো ও ইদলিবের বিদ্রোহীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এই বিদ্রোহীরা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমরা ইসরায়েলকে ভালোবাসি এবং আমরা কখনই এর শত্রু ছিলাম না... (ইসরায়েল) তাদের প্রতি শত্রুতা করে না যারা এর প্রতি শত্রুতা করে না। আমরা আপনাদের ঘৃণা করি না, আমরা আপনাদের অনেক বেশি ভালবাসি।”
টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর ওপর বোমা হামলার জন্য সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের প্রশংসা করেছে। তারা আলেপ্পো জয় করতে সাহায্য করার জন্য লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের কৃতিত্ব দেয়।
সিরিয়ার একজন বিদ্রোহী কমান্ডার ইসরায়েলের চ্যানেল টুয়েলভকে জানিয়েছেন, তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করতে এবং ‘ইসরায়েলসহ’ এই অঞ্চলের সব দেশের সাথে সুসম্পর্কের একটি নতুন সরকার গঠন করতে চায়।
বিদ্রোহী কমান্ডার ইসরায়েলকে সিরিয়ার ওপর সরাসরি আক্রমণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “আমরা ইসরায়েলি নেতৃত্বকে সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের অবস্থান এবং সেনাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালানোর আহ্বান জানাই।”
সিরিয়াতে আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট ‘বিদ্রোহীদের’ সরাসরি সমর্থন করছিল ইসরায়েল। বিষয়টি ২০১৯ সালে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আইডিএফের চিফ অফ স্টাফ গাদি আইজেনকোট প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ইসরায়েল সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়েছে প্রেসিডেন্ট আসাদের সরকারকে উৎখাত করার জন্য।
শুধু বিদ্রোহীদেরই নয়, বরং সিরিয়ার আল-কায়েদাকে সরাসরি সাহায্য করেছে ইসরায়েল। ২০১৫ সালে টাইমস অফ ইসরায়েল রিপোর্ট করেছিল যে “চলমান গৃহযুদ্ধে আহত নুসরা ফ্রন্ট এবং আল-কায়েদা যোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ইসরায়েল সিরিয়ার সাথে তার সীমান্ত খুলে দিয়েছে।”
ওই বছর আল-কায়েদাকে ‘কম মন্দ’ আখ্যা দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান আমোস ইয়াডলিন বলেছিলেন, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের মতো শিয়া ইসলামী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ‘ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি, এমনকি উগ্র সুন্নি ইসলামপন্থীদের চেয়েও অনেক বড় হুমকি।’
ইয়াডলিন আনন্দের সাথে বলেছিলেন, আল-কায়েদা ‘ইসরায়েলকে বিরক্ত করেনি’ এবং পরিবর্তে তারা ইসরায়েলের শত্রুদের সাথে লড়াই করার দিকে মনোনিবেশ করেছিল।
সাবেক এই গোয়েন্দা প্রধান বলেছিলেন, “যে সুন্নি গোষ্ঠীগুলো গোলান হাইটস সীমান্তের দুই-তৃতীয়াংশ থেকে ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তারা ইসরায়েলে আক্রমণ করছে না। এটি আপনাকে মনে করার কিছু ভিত্তি দেয় যে তারা বুঝতে পারে কে তাদের আসল শত্রু - সম্ভবত এটি ইসরায়েল নয়।”
ইহুদিবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেগিন-সাদাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছিল, পশ্চিমের আইএসআইএসকে (ইসলামিক স্টেট) ধ্বংস করা উচিত নয়, কারণ এটি ইরান, হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘উপযোগী হাতিয়ার।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জোর দিয়ে বলেছিল, “আইএসের (ইসলামিক স্টেট) অব্যাহত অস্তিত্ব একটি কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করে।”
আইএসের সন্ত্রাসীরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল তখন তারা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিল। ২০১৭ সালে ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে ইয়ালন বলেছিলেন, গোলান হাইটসে ভুলবশত ইসরায়েলি বাহিনীকে আক্রমণ করার পরে তেল আবিবের কাছে ‘ক্ষমা চেয়েছিল’ আইএস। অথচ সিরিয়ার এই ভূখণ্ডটি কয়েক দশক ধরে অবৈধভাবে ইসরায়েলের দখলে রয়েছে।
সার্বিক পর্যালোচনায় বোঝা যায়, সিরিয়াকে ইরানের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইসরায়েল সেখানে একটি প্রক্সি গ্রুপ তৈরি করেছে। আর এই প্রক্সি গ্রুপ যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তা হয়তো বলাই বাহুল্য। গত বছর তেল আবিব গাজা আক্রমণের পর লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর হামলা শুরু করেছিল। চলতি বছর ইরান সরাসরি হামলা চালায় ইসরায়েলের ওপর। এবার ইরানকে ধরাশায়ী করতেই হয়তো ১৩ বছর পর সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অতিমাত্রায় সক্রিয় করে তুলেছে ইসরায়েল।