ক্যাম্পাস

বুদ্ধিজীবীদের একাল-সেকাল

ডিসেম্বর মাস মানেই বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর আমরা অর্জন করি আমাদের বহুল কাঙ্খিত স্বাধীনতা। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস আসলেই প্রতিটা বাঙালীর হৃদয়ে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়।

কিন্তু বিজয়ের পূর্ণ আনন্দ আমরা হয়তো কখনোই লাভ করতে পারব না। কারণ দেশ স্বাধীন হবার দুইদিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে এ দেশের কিছু নরপিশাচ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের সহযোগিতায় বাংলাদেশকে চিরতরে মেধাশূন্য করার নীল নকশা অনুযায়ী দেশের মূল স্তম্ভ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দেশ স্বাধীনের পর যাদের মেধা এবং বুদ্ধির উপর ভর করে আমাদের যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নত দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই পথ প্রদর্শকদেরই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। 

কে বা কারা বুদ্ধিজীবী? এটা নিয়ে একেকজনের একেক রকম মতামত। যার বুদ্ধি আছে এবং সেই বুদ্ধি যিনি জনস্বার্থে ব্যবহার করেন অথবা দেশ, জাতি ও সমাজকে অগ্রগতির দিকে টেনে নিতে স্বচেষ্ট হন, তিনি বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী সমান্তরাল মেরুতে অবস্থান করেন।

কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক শ্রেণির মধ্য থেকেই সাধারণত বুদ্ধিজীবীদের উত্থান লক্ষণীয়। তবে সমাজের নিম্নস্তর থেকেও বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটে। বুদ্ধিজীবীরা যে সব সময় উচ্চ শিক্ষিত হবেন এমন নয়। তিনি স্বল্প শিক্ষিত বা স্বশিক্ষিতও হতে পারেন। কোন দেশকে বুদ্ধিজীবী হীন করতে পারলেই সেই দেশের অগ্রগতি রোধ করা সম্ভব হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। পাকিস্তান নরপিশাচেরা যখন বুঝতে পারলো তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত, তখন ভবিষ্যতে এ দেশ যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে লক্ষ্যে রাজাকার, আল-বদরদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ আবহমানকাল আমাদের সেই বুদ্ধিজীবীদের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকবে।

অনেক বুদ্ধিজীবীই সেদিন প্রাণে বেঁচে যেতেন, যদি তারা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আপোষ করতে রাজি হতেন। কিন্তু আমাদের তৎকালীন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে পূর্ব বাংলার লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ বুদ্ধিজীবীরা সর্বদা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন এবং জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তৎকালীন সরকারের সঙ্গে জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে কখনো আপোষ করেননি। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সর্বদা সত্য প্রকাশ করেছেন অকপটে। 

১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার থেকে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকার জো-টি নেই।”

এর আগের বছর দেশ ভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল। তিনি যখন এ কথা বলেছেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে জ্ঞান, সততা এবং নিষ্ঠার জোরে এমন কথা বলার সাহস তিনি করেছিলেন। ভাবতেই অবাক লাগে, এখনকার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা অনেকটা বেছে বেছে নিজেদের গা বাঁচিয়ে যেকোন বিষয়ে মতামত দেন।

গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর দেশের অনেক জায়গায় দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা হামলা এবং বাড়িঘরে লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক হামলার ঘটনা হিসেবে প্রচার করার একটা প্রয়াস দেখা গেছে। রাজনৈতিক বিরোধিতার জেরেও হামলা হয়েছে।

কিন্তু সব ঘটনাই রাজনৈতিক ছিল না। সর্বশেষ সুনামগঞ্জের ঘটনার দিকে তাকালেই আমরা তা বুঝতে পারি। এতবড় ঘটনার পরও দেশের অধিকাংশ জ্ঞানী-গুণীজন চুপ ছিলেন, গুটিকয়েক ছাড়া কেউ টু শব্দটি করেননি। যে বা যারা এসব ঘটনা ঘটাল, তাদের নিয়ে কিংবা এই ঘটনার মূল কারণ নিয়ে তেমন একটা কাউকে বলতে দেখা গেল না।

এ সংকটময় সময়ে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক আহমদ ছফার একটা কথা মনে খুব বাজছিল। তিনি তার বই ‘বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ লিখেছেন, “যারা মৌলবাদী, তারা শতকরা ১০০ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন, তাদের কেউ কেউ ১০ ভাগ প্রগতিশীল, ৫০ ভাগ সুবিধাবাদী, ১৫ ভাগ কাপুরুষ এবং পাঁচ ভাগ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।”

অবশ্য বিভিন্ন সময় তার এ কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এবারের ঘটনায় একজন স্বাভাবিক মানুষও এটা বুঝতে পেরেছে, দেশে আর আগের মতো সেই সূর্যসম তেজস্বী বুদ্ধিজীবী নেই। যারা আছে তাদের অধিকাংশই সুবিধাবাদী।   আগেরকার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতেন না। নিজে সুবিধা পাওয়ার লোভে সত্য গোপন করতেন না। আর পরবর্তীতে স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের এটাই ছিল সবথেকে বড় অপরাধ। যে কারণে তাদের জীবন দিতে হলো। 

সেকালের বুদ্ধিজীবী আর একালের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেক তফাত। বর্তমান বুদ্ধিজীবী মহলে ডিজিটাল বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্যের কারণে আসল বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। লেজুড়বৃত্তিকারী ও তৈলমর্দনকারী বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাই যেন বেশি মনে হয়। একালের বুদ্ধিজীবীরা আরো বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। আর তা হলো- পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা এবং আত্মম্ভরিতা।

আহমদ ছফা ‘বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ আরো লিখেছেন, “বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের রচনার মধ্যে মানসিক বন্ধ্যাত্বের চিহ্ন যে কেউ  খুঁজে বের করতে পারেন। তারা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলেন, শুনে মনে হবে- আবাহনী মোহামেডান টিমের ভাড়া করা বিদেশি খেলোয়াড়ের মতো তাদেরও ভাড়া করা হয়েছে। তারা যখন বাঙালির জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, শুনে মনে হবে- টেক্সট বই থেকে কথাগুলো মুখস্থ করে হাজেরান মজলিশের শ্রোতাদের সামনে বমি করে দিচ্ছেন। তারা যখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন গোদা পায়ের লাথির সঙ্গে তুলনা করা যায়।” (পৃ-১১)

গ্রাম বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘চাচীর তরকারিতে জায়গায় জায়গায় ঝাল আবার জায়গায় জায়গায় মিষ্টি।’ এখনকার হাইব্রিড এবং ডিজিটাল বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলেও ঠিক তাই মনে হয়। একই ঘটনায় যাদের থেকে সুবিধা পাবে, তাদের বিষয়ে একরকম মতামত, আর বিরোধী পক্ষের বিষয়ে অন্যরকম মতামত দেন। তবে এখনো যে বুদ্ধিজীবী নেই, তা নয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তবে এসব তৈলমর্দনকারী, হাইব্রিড বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ভুরি ভুরি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাতির পথপ্রদর্শক। বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এ পেশায় দেখা যেত একসময়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক রাজনীতি এমন প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কিছু শিক্ষক বাদে বাকি সবাই স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে লেজুড়বৃত্তিতে মেতে আছেন। এটাই বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য। স্বৈরাচার পতন পরবর্তী সময়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, এ অবস্থার হয়তো পরিবর্তন হবে। কিন্তু শিক্ষকদের বিভিন্ন দলীয় রাজনীতি আগের মতোই রয়ে গেছে।

পূর্ববর্তী সরকারের শাসনামলে যারা সত্য কথা বলতেন, বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করতেন না; সে মানুষগুলোকে বিভিন্নভাবে কটুক্তি করা হতো। এমনও বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা কিছু লোক....।’ তবে ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারা সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। স্বৈরাচার পতনে তাদের ভূমিকা অপরিসীম।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- স্বৈরাচার পতনের পরও জ্ঞানী-গুণীজনদের মধ্যে যারা নিরপেক্ষভাবে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, তাদের উপর একটি স্বার্থান্বেষী মহল পূর্বের ন্যায় বিষোদগার করছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।

বুদ্ধিজীবীরা যখন রাজনৈতিক দলের লেবাসে চলবেন, তখন জাতির দুর্দশা বাড়তেই থাকবে। এমনটা কারোরই কাম্য নয়। এর পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নইলে সেকালের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আমাদের যে অহংকার ছিল, হয়তো আমাদের একালের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সে অহংকারে কালীমা লিপ্ত হবে।

বুদ্ধিজীবীরা জাতির মূল ভরসাস্থল। যখন কোন জাতির অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা লেজুড়বৃত্তি শুরু করেন, তখন ধরে নিতে হবে সেই জাতির ধ্বংস আসন্ন। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এমন হবেন না, এটাই সবার চাওয়া। তাদের জ্ঞান এবং কর্মের ওপর ভিত্তি করে দেশ এগিয়ে যাবে, এটাই কাম্য।