একাকী জীবন এবং মননচর্চার কারণে ‘নিঃসঙ্গতার কবি’ হিসেবে বাংলা কবিতা-ভুবনে খ্যাতি ছিল হেলাল হাফিজের। ‘ছিল’ শব্দটি কবির সঙ্গে বেমানান। তারপরও বলতে হয়, নিঃসঙ্গতার যে বন্ধনে জড়িয়েছিলেন কবি, সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন আরো গহীনে; গহীন গগনে। সেখানেই তারা হয়ে জ্বলবেন চিরদিন।
নিঃসঙ্গ কবির প্রিয় অনুষঙ্গ
হেলাল হাফিজের নিঃসঙ্গই ছিল প্রিয় অনুষঙ্গ। ‘মানুষ মাত্রই একা’ কথাটি আমরা এতোদিন শুধু শুনেছি, জেনেছিও ব্যক্তিজীবনে অনেকে। কিন্তু কবিকেই দেখেছি সেই একাকীত্ব উপভোগ করতে। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। জীবনের অবলম্বন বলতে ছিলেন কেবল বাবা। তিনিও ১৯৭৩ সালে না ফেরার দেশে চলে যান। এরপর একা হয়ে যান কবি। সংসারে থাকতে অবলম্বন লাগে, অবলম্বন মানে মানুষ- একান্তই আপন মানুষ। কিন্তু কেউ নেই। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর প্রিয়তমা হেলেনের সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটে তার।
একদিন কবিকে ডেকে হেলেন বলেন, ‘‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’’ প্রত্যুত্তরে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে …চলে এলাম।’’
বোহেমিয়ান
হেলাল হাফিজ ছিলেন বোহেমিয়ান। অবিবাহিত। জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন রাজধানীর তোপখানা রোড আর সেগুনবাগিচার আবাসিক হোটেলে। প্রতিদিন খেতে যেতেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। তিনি ছিলেন প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন। ব্যক্তিজীবনে খুব শান্ত আর অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কবি শামীম আজাদ বলেন, ‘‘ব্যক্তিগতভাবে ও ছিল খুবই শান্ত চুপচাপ ধরনের, কিন্তু আড্ডার প্রাণ ছিল।’’
তখন তো বুঝতে পারিনি, এত বড় একটা বেদনা
এক সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘‘আমি স্কুলজীবনে ছিলাম খেলাধুলার মানুষ। এই ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল; ক্রিকেটে অতটা আগ্রহ ছিল না। এমনকি নেত্রকোণার মতো একটা মফস্বল শহরে আমি ওই সময়ে লং টেনিস শিখেছি। সেটা সম্ভব হয়েছিল আব্বার জন্য। আব্বা যেহেতু নামকরা শিক্ষক, নেত্রকোণার এলিট যারা টেনিস খেলতেন বিশেষ করে ডাক্তার বা আইনজীবী বা কলেজের প্রিন্সিপাল, অধ্যাপক; আমি মাঠের পাশে বসে থাকতাম। প্রথম হলো যে বল বয়, বল কুড়িয়ে এনে দেওয়া। এই করতে করতে...। আসলে আমি ছিলাম খেলাধুলার মানুষ। এরপর ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। তখন তো বুঝতে পারিনি, এত বড় একটা বেদনা! বয়স যখন বাড়তে লাগল বেদনা আমরা ভেতরে শিকড় গজাতে লাগল, গ্রাস করে ফেলল আমাকে। এই মাতৃহীনতার বেদনা আমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে।’’
দুঃখের ফেরীঅলা
‘অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’। ‘প্রতিমা’ কবিতায় এভাবেই ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন হেলাল হাফিজ। ‘প্রস্থান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, “এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, পত্র দিয়ো।” এই কবিতায় অভিমানের সুরে তিনি বলেছেন, “আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই।”
কবিতার শেষে গিয়ে কবি বলছেন: ‘‘এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে, এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে’’।
ঠিক এতসব কষ্ট নিয়েই তিনি চলে গেলেন (১৩ ডিসেম্বর ২০২৪) আরো গহীনে; গহীন গগনে।