জাতীয়

‘বদলে যাওয়া’ বাংলাদেশ, ‘অন্য রকম’ বিজয় দিবস

ছত্রিশে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। নতুন এই দেশে তাই এবারের বিজয় দিবসের আনন্দে নব নব মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্য ও বীরত্বের অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন ১৬ ডিসেম্বর। আজ আমাদের বিজয় দিবস। এই দিনটি বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। আজ আমাদের বলার দিন, “বল বীর বল উন্নত মম শির।”

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম সগৌরবে উচ্চারণের দিন আজ ১৬ ডিসেম্বর। আজ আমাদের বলার দিন-“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।”

বিজয় দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিজয়ের দিনে তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রাকে সমুন্নত রাখতে জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় দিবসটা ঠিক কীভাবে উদ্‌যাপন করা হবে-তা নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল জনমনে। অবশ্য এবারের বিজয় দিবস সগৌরবে যথাযথ মর্যাদায় দেশে ও বিদেশে উদযাপন করছে বাংলাদেশিরা। 

তবে পাল্টে গেছে বাস্তবতা। সরকার পাল্টেছে, শীর্ষ ব্যক্তিসহ সরকারি লোকগুলো বদলে গেছে। আর বদলে গেছে দেশের রাজনীতির হাওয়া; নতুন হাওয়ায় গণমানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার বিজয় অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকেই লক্ষ্য ধরা হচ্ছে। 

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ফ্যাসিজমের অভিযোগ। তারা এখন বিচারের কাঠগড়ায়। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। সেদিন শেখ হাসিনা আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর ৩ দিন সরকারবিহীন থাকে দেশ। ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের ভার যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ৪ মাস পর এলো মহান বিজয় দিবস। সব রাজনৈতিক দল, আপামর জনতা মিলে উদযাপন করছে এবারের বিজয় দিবস। শুধু নেই আওয়ামী লীগ। এবার আর বিজয় দিবসে বাজবে না আওয়ামী লীগের জয়গান। উল্টো মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের বিচারের দাবি দেশজুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। 

যেভাবেই আর যে রূপান্তরের মধ্য দিয়েই সামনে যাক দেশ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ হোক উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ; এ-ই চাওয়া লাল-সবুজের পাতাকার জমিনে সর্বজনে। 

বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন আজ। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাহেন্দ্রক্ষণ; চিরগৌরবে সমুজ্জ্বল মহান বিজয় দিবস। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে বাংলাদেশ নাম প্রতিষ্ঠার মাইলফলকের দিন। আজ বিজয়ের দিন, আজ বাঙালি জাতির গর্বের দিন।

১৯৭১ সালের এই দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে জাতি নিজেদের জন্য বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাম সংযোজিত করেছিল এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে।

পাকিস্তানের নৃশংস হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যখন এ দেশের ঘুমন্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংক-কামানের মতো ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাস হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো এক শক্তিমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ করেছিলেন দেশের সব ধর্ম, বর্ণ, ভাষার বীর সন্তানেরা।

৩০ লাখ মানুষের প্রাণ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর বিপুল সম্পদহানির ভেতর দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে সফল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ছিনিয়ে এনেছিলেন চূড়ান্ত বিজয়। জাতিকে মুক্ত করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। ৫৩ বছর আগে ডিসেম্বরের এই দিনে কুয়াশাঢাকা বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য, উড্ডীন হয়েছিল লাল-সবুজ পতাকা।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।  

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, ‘‘১৬ ডিসেম্বর, আমাদের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা অর্জন করেছি কাঙ্ক্ষিত বিজয়। আমরা পেয়েছি একটি সার্বভৌম দেশ, পবিত্ৰ সংবিধান, নিজস্ব মানচিত্র ও লাল-সবুজ পতাকা। পেয়েছি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজেদের অস্তিত্ব আর মর্যাদা। বিজয়ের আনন্দঘন এ দিনে আমি দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে জানাই বিজয়ের শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন।’’

তিনি বলেন, ‘‘বিজয়ের এই দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি সব জাতীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা দুই লক্ষ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধু, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণকে, যারা আমাদের বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। আমি আরো স্মরণ করি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকে। জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।’’

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘‘এ বছর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন এ দেশের মানুষ দেখেছে তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে বলে আমি মনে করি। বীরের দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করবে-ইনশাআল্লাহ।’’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বাণীতে বলেন, ‘‘বিজয় দিবস কেবল আমাদের গর্বের উৎস নয়, এটি আমাদের শপথের দিনও। শপথ আমাদের একতাবদ্ধ থাকার, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার।’’

তিনি বলেন, ‘‘আজকের এই দিনে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাই। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুশাসিত বাংলাদেশ গঠনে সবাই মিলে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করছে।’’

‘‘দেশকে আরো উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল ভোগ করতে আমরা বদ্ধপরিকর,’’ বলেও তিনি অঙ্গীকার করেন।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এবার প্রথমবারের মতো ঢাকাসহ সব জেলা-উপজেলায় বসছে ‘বিজয় মেলা’। রাজধানীতে ‘বিজয় মেলা’ হবে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে। সেখানে এখন চলছে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে ২২টি স্টল বসানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চারপাশের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।

কর্মসূচি

যথাযোগ্য মর্যাদায় ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

১৬ ডিসেম্বর প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপনের আনুষ্ঠনিক সূচনা হবে।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

বিদেশি কূটনৈতিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।

দিনটি সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে।

মাসব্যাপী ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।

দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী আড়ম্বরপূর্ণ বিজয়মেলা আয়োজন করা হয়েছে। শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

বঙ্গভবনে অপরাহ্নে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারগুলোকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দিবসটি উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করছে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হয়েছে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করার কথা।

চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা (নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে এবং চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজসমূহ দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখ হয়েছে।

দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহ বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে এবং সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ররাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।