সাত সাগর আর তের নদীর ওপারে সেন্ট ভিনসেন্টের কিংসটাউন থেকে বিজয় দিবসের সকালে এলো দুর্দান্ত এক জয়ের খবর। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭ রানে হারিয়ে তিন ম্যাচ সিরিজের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রথমটিতে জয় তুলে নিয়েছে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা।
আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে বিজয় দিবস। দেশজুড়ে বিজয়ের আনন্দে যোগ হলো ক্রিকেটীয় বিজয়ের উল্লাসও। লাখ লাখ প্রিয়জনের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা, অশ্রু বিসর্জনে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের কাছে সবচেয়ে গৌরবের। ঠিক তেমনই ক্রিকেট এখন আবেগের জায়গা। অনুভূতির চিরস্থায়ী বন্ধন। ২২ গজে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোয় বিজয়ের দিনে আরো রঙিন হলো বিজয়ানন্দ।
টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ‘যেমন-তেমন’ হলেও ওয়ানডে ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাস থাকে তুঙ্গে। অথচ এবার ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জে সফরে ওয়ানডেতে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। অস্বস্তিকর দম বন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকে স্বস্তি ফেরাতে, আনন্দের ভেলায় ভাসাতে, পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে প্রয়োজন ছিল টি-টোয়েন্টি জয়। নিজেদের সেই মিশনে প্রথম পরীক্ষায় খুব ভালোভাবেই উতরে গেল বাংলাদেশ।
কিংসটাউনে ৭ রানের ব্যবধানে ফয়সালা হওয়া ম্যাচের শেষটা ছিল অতি রোমাঞ্চের, উত্তেজনার। স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের পুঁজি ছিল কেবল ১৪৭ রান। ওই পুঁজি নিয়ে বোলাররা লড়াই করলো। ছাড় দিল না এক মুহুর্ত পর্যন্ত। ৬১ রান তুলতেই স্বাগতিকদের নেই ৭ উইকেট। সেখান থেকে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে প্রতি আক্রমণে গিয়ে সফরকারী বোলারদের ওপর ঝড় তুললেন অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েল। শেষ ওভারের আগে পর্যন্ত তার একক কৃতিত্বেই ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেন।
কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবালেন রোভম্যান। কৃতিত্ব দিতে হবে হাসানকেও। শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে ডট খেলানোর পর তৃতীয় বলে তুলে নেন উইকেট। ব্যাস, ওখানেই ম্যাচের এপিটাফ লিখা হয়ে যায়। ১৪০ রানে সবকটি উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ হেরে যায় ৭ রানে।
কিংসটাউনের এই মাঠে ১০ বছর পর খেলতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্বাগতিকদের সমর্থন করতে গোটা গ্যালারি প্রায় ভরা ছিল। দুই দলের পারফরম্যান্সে পয়সা উসুল করা ম্যাচ দেখলেও অতিথিরা শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে যাওয়ায় উন্মাদনা কিছুটা কমে গেছে নিশ্চিতভাবেই।
আগের দিন লিটন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জন্য টি-টোয়েন্টি সিরিজ কঠিন হবে। বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখে তেমনটাই বোঝা গেছে। ৩০ রানে ৩ উইকেট হারানো এবং শতরানের আগে আরো ২ উইকেট হারানো সেই কথাই বলছে। সৌম্য ও জাকের চেষ্টা করেছিলেন। ৫৭ রানের জুটিও গড়েছিলেন। কিন্তু তারা কেউ শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। সৌম্য ২ চার ও ৩ ছক্কায় ৩২ বলে ৪৩। দলের হয়ে সর্বোচ্চটা এসেছে তার ব্যাটেই। জাকের ২৭ বলে করেন ২৭ রান। বাংলাদেশের ইনিংসের চিত্র পাল্টে দেন শামীম ও মাহেদী। শামীম ক্রিজে এসে ৭ বলে ৩টি ছক্কা হাঁকান। ১২ বলে ২৭ রান আসে তার ব্যাট থেকে। মাহেদী ২৪ বলে করেন ২৬ রান। ২৯ বলে ৪৯ রানের জুটি গড়েন শামীম ও মাহেদী।
মাঝারি মানের পুঁজি নিয়ে লড়াইয়ের চিন্তা করা যায়। জয়টা একটু বেশি-ই বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের বোলিং যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে জয়টাই হয়ে উঠে স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে বোলারদের মধ্যে মাহেদী এগিয়ে আসেন। নিজের ক্যারিয়ার সেরা ৪ ওভারে ১৩ রানে ৪ উইকেট নেন অফস্পিনার। তার ঘূর্ণিতে এলোমেলো হয়ে পথ হারানো শুরু স্বাগতিকদের। এক পর্যায়ে তাদের স্কোর ৭ উইকেটে ৬১।
কিন্তু রোভম্যান টিকে থাকায় ভয় ছিল। সেই ভয়-ই শেষ পর্যন্ত কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তাসকিনকে এক ওভারে তিন ছক্কা, সাকিব ও রিশাদকে পরপর দুই ওভারে দুটি করে চার মেরে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা আড়াল করে দিতে থাকেন। ২৮ বলে তুলে নেন ফিফটি।
মনে হচ্ছিল শেফার্ডকে নিয়ে দলকে সহজেই বন্দরে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তাসকিন আহমেদ তাদের ৩৩ বলে ৬৭ রানের জুটি ভাঙার পর হাসান বাকি কাজটা করে দেন শেষ ওভারে। প্রথমে রোভম্যানকে দর্শক বানিয়ে উইকেটের পেছনে লিটনের হাতে তালুবন্দি করেন। পরবর্তীতে বোল্ড করেন আলজারি জোসেফকে। তাতে জয় সুনিশ্চিত হয়ে যায় লাল সবুজ প্রতিনিধিদের।
মাঝে কয়েকটি ওভারে প্রচুর রান হলেও বাংলাদেশ এই ম্যাচে এক মুহূর্তের জন্য মনোবল হারায়নি। ওয়ানডের ব্যর্থতা টি-টোয়েন্টি দিয়ে কাটিয়ে দিতেই হয়তো দৃঢ়চেতা মনোবল, হার না মানা মানসিকতায় মাঠে নেমেছে। বোলিংয়ে সেই চিত্রটাই ধরা পড়েছে। জেতার পরও ব্যাটিংটা এখনো উদ্বেগের জায়গা।