জাতীয়

নবযাত্রায় নতুন উদ্যম ও উদ্দীপনায় জাতির বিজয় উদযাপন

নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় হয় সার্বভৌম বাংলাদেশের। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এবারের বিজয় দিবস তাই একেবারে ভিন্ন আবহ নিয়ে এসেছিল। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সেরা দিনটি আজ উদযাপনও করেছে ভিন্ন আমেজে, ভিন্ন উচ্ছ্বাসে। এই নবযাত্রায় নতুন উদ্যম ও উদ্দীপনায় জাতি আজ স্মরণ করেছে দেশের বীর সন্তানদের।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর অধিকাংশ দেশবাসী এ সময়টাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা' বলেও অভিহিত করছে। বৈষম্যহীন নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে বিজয়, স্মরণ করেছে জাতির গৌরবগাঁথা।

তবে এবারের বিজয় দিবসে কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি স্ট্যাটাস ঘিরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় দিবসকে ১৯৭১ সালে ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়' বর্ণনা করে মোদির দেওয়া স্ট্যাটাস ঘিরে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

এর আগেও স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের মতো বিশেষ বিশেষ দিনে নিয়মিতই নিজের বার্তা পোস্ট করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তবে তার বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায় সাধারণত বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখ থাকে না। কারণ বিজয় দিবসকে ভারত তথা ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধে তাদের বিজয় হিসেবেই তুলে ধরে থাকে।

শুধু নরেন্দ্র মোদি নন ভারতের সামরিক বাহিনী কিংবা অন্য রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকেও ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনটিকে বরাবরই ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য' হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ একরকম অনুচ্চারিতই থেকে যায়। তবে, বাংলাদেশে এর আগে কখনও সরকারি বা রাজনৈতিক পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে এত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

আ‍ওয়ামী লীগ সরকার এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতি থেকে কূটনীতি সবক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই স্ট্যাটাস ঘিরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

এ বিষয়টি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের এবারের বিজয় দিবস দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নতুন আঙ্গিকে উদযাপন হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাসে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি উদযাপিত হয়েছে। ‍দূতাবাসগুলো থেকে প্রাপ্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৯৭১ সালে আত্মোৎসর্গকারী শহীদের এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নিহত শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বাণী পাঠ করে শুনানো হয়।

এছাড়া, দূতাবাসগুলোতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ওপর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘আধার পেরিয়ে’ প্রদর্শন করা হয়।

বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা

দেশে সরকারিভাবে জাতীয় কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হয়। আজ দেশে ছিল সরকারি ছুটি।

সকালে ঢাকা পুরাতন বিমান বন্দর এলাকায় (তেজগাঁও) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টের ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি গান-স্যালুট প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভে মোমবাতি প্রজ্বলন ও শহীদদের প্রতি দোয়া এবং মোনাজাতে অংশ নেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। রবিবার দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিটে তারা মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। এরপর তারা ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করেন। এ সময় জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, মুখপাত্র সামান্তা শারমীনসহ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আজ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সকাল ৭টা ১২ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তার সঙ্গে পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তাও ছিলেন। এরপর জাতীয় স্মৃতিসৌধে সরকারের উপদেষ্টা, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দেশের জন্য আত্মদানকারী বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল নামে।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আজ সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি বেতার/টিভি চ্যানেলে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল ইতিহাস ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় বার্তা সংস্থা-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গতকাল রাত থেকেই আলোকসজ্জা করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা করে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহে বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ঢাকাসহ দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিনেমা হলসমূহে বিনা টিকেটে ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহকৃত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং মিলনায়তনে ও উন্মুক্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।

বিজয় দিবসটি উপলক্ষে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের সংগ্রামের ইতিহাস ও বিজয় স্মরণে র‌্যালি করেছেন ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ র‌্যালির আয়োজন করে। দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-শাহবাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে র‌্যালিটি শেষ হয়।

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আসলেও সেই স্বাধীনতা ছিল অরক্ষিত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিজয় আমাদের স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিয়েছে।’’

দেশবাসীকে মহান বিজয় দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪-এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে জনগণ প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ অনুভব করছে।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফ্যাসিজম ও আধিপত্যবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের পক্ষ থেকে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পনের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল ও খায়রুল কবির খোকন উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ আখাউড়া-আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আইএসপিআর জানায়।

বিজয় দিবসে বাংলাদেশ-ভারতের সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের সাক্ষাৎ

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৮টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ স্মৃতিসৌধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)।

দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সকালে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল ৯টায় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএসএমএমইউ ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও বৃক্ষরোপণ, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বাদ জোহর দোয়া-মোনাজাতসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়াও জাতীয় এই দিবস উপলক্ষে আজ রোগীদের ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের মধ্যে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।