সাতসতেরো

হেলাল হাফিজের শেষ দিনগুলো

গত বছর ইদুল ফিতরের পরে কবি হেলাল হাফিজের সঙ্গে দেখা করতে হাজির হই ‘হোটেল সুপার হোম শাহবাগ’ এ। আমার সঙ্গে ছিলেন রাইজিংবিডির নির্বাহী সম্পাদক তাপস রায়। অসুস্থ কবি হোটেলের লবিতে বসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার দিনযাপনের গল্প শোনালেন। কে জানতো ওই দেখাই হবে শেষ দেখা! হেলাল হাফিজ মারা গেছেন। তার কবিতা আর কবিতার মতো বেদনা ও ভালোবাসায় মোড়ানো কথাগুলো আমাদের মনে আছে, থাকবে। হোটেলের লবিতে বসে কবিকে প্রশ্ন করেছিলাম কেমন আছেন?—প্রশ্নের জবাবে তিনি শুনিয়েছিলেন তার শেষ জীবনের একান্ত অসহায়ত্বের কথা। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য সেই আলোচনার চুম্বক অংশ তুলে ধরছি।

হেলাল হাফিজ বলেন, ‘‘আমি অসুস্থ, অরগানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। কিডনি, লাং, হার্ট সব দুর্বল হয়ে গেছে। চোখতো আগে থেকেই নষ্ট। এটা আরও দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। কানেও শুনিনা। সব কিছু ডায়াবেটিস থেকেই হয়েছে। ৭৬ বছর বয়স হয়েছে। অনেকগুলি দাঁত পড়ে গেছে। ডায়াবেটিস না থাকলে হয়তো এতোগুলি পড়তো না। নাকে কোনো ঘ্রাণ পাই না। এই সমস্যাগুলি এমনেও হয় অল্প অল্প। আমার সমস্যাগুলি বেশি হয়ে গেছে এই ডায়াবেটিসের জন্য। নিয়ম মানতে পারি না ঠিকমতো এটাও একটা কারণ। পানি গ্লাসে ঢালতেও কষ্ট হয়। চোখে ঝাপসা দেখি তো, পানি ঢালতে গেলে অনেক সময় গ্লাসের বাইরে পড়ে যায়। আরেকটা বড় সমস্যা সময় কাটে না। বই পড়তে পারি না। চোখে দেখি না, গ্লুকোমায় ভুগছি। বই পড়তে পারলে সময়টা আনন্দের সাথে কেটে যেত। কখনো পছন্দের বই, কখনো নভেল কিংবা কাব্য বা ভ্রমণ পড়তে পারতাম। যেটা যখন ভালো লাগে সেটা যদি পড়তে পারতাম সময়টা ভালো কাটতো। বই পড়তে পারলে সময়টা কেটে যায়, আনন্দের সঙ্গে কেটে যায়। কারও কোনো খেয়াল করার দরকার হয় না। ’’

হেলাল হাফিজকে যারা খুঁজে বেড়ান তারা জানেন কবিকে কোথাও পাওয়া না গেলেও প্রেস ক্লাবে পাওয়া যাবে। প্রেস ক্লাবেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন হেলাল হাফিজ। ক্লাবের খাবার ছিল তার অন্যতম প্রিয় খাবার। কিন্তু একটা সময় শরীর তাকে ক্লাবে যাওয়ার সায় দেয়নি। কবি নিরুপায় হয়ে হোটেলেই থেকেছেন। কখনো সামান্য খেয়ে কখনোবা শুধু বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু না খেলেই নয় সেটুকু খেয়ে পার করেছেন দিন।

হেলাল হাফিজ বলেন, ‘‘আমিতো এখন ক্লাবেও যেতে পারি না। যদি ক্লাবে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো ১০টায় গিয়ে দুপুরে ওই খানেই খেতাম, বিকালে ওইখানেই নাস্তা করতাম; পরে সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় চলে আসতাম। তাহলে হোটেলের খাওয়াটা না খেয়ে ক্লাবের খাওয়াটা খেতে পারতাম। এখন আমিতো হোটেলের লবিতেও নামি না। আজ একটু নামলাম। কেউ আসলে তাকে উপরেই (রুমে) নিয়ে যাই। সর্বশেষ (২০২৩) এ বেশি শীত পড়েছে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। বেশি শীতে অক্সিজেনের অভাব হয়। দুইটা শব্দ উচ্চারণ করলে থার্ড শব্দটা আর গলা দিয়ে বের হয় না, বুকে আটকে যায়। তখন দম বন্ধ হয়ে যায়। ’’

কবির বৈভব তার কবিতা। কবিতাকে যারা ভালোবাসেন, তারা কবিকে খুঁজে নেন। কিন্তু সেই মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে বলেই মন্তব্য করেন হেলাল হাফিজ। তারপরেও কবিতাকে নিয়ে ফিরেছেন তার মনে ও মগজে। কবি বলেন, ‘‘আমারতো কোনো বিত্ত-বৈভব নাই। আমি কবি। কবিকে ভালোবাসার মানুষ কমে যাচ্ছে। তারপরেও কবিতা মনে-মগজে দুই জায়গায়ই আছে। কিন্তু ওগুলো লিখতে বসতে পারি না। শক্তি পাই না। খাবারটা ঠিক মতো খাইতে পারি না। এমনও হয়, দুই নলা খাবার কোনো সময় জোর করে খাই। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে একটু মাংসও খেতে পারি না। ইফতারিতে বুট খাইতে পারি না, মুড়ি চাবাতে পারি না। একটু আধটু খেজুর খাইতে পারলেতো উপকার পেতাম তাও খাইতে পারি না। এই বয়সে এইগুলি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি একটু বেশিই বিপদে পড়ে গেছি। এসব সমস্যাতো আপনজন ছাড়া কাউকে বলাও যায় না, একা একাই হজম করতে হয়। এটাও একটা দুঃখের বিষয়।’’

হেলাল হাফিজ শেষ বেলাতেও তার প্রিয় গ্রামে ফেরেননি। অথচ গ্রামের প্রতি তার ভালোবাসার অভাব ছিল না। এই নিয়ে হেলাল হাফিজের ভাই নেহাল হাফিজের অভিমান ছিল, আছে। কিন্তু কবি কেন বাড়ি ফেরেন নি সেই প্রশ্ন করলে তিনি নিরব হয়ে যান। কোনো উত্তর দেননি। 

তার নিরবতাও কবিতার মতো রহস্যঘেরা। যার উত্তর কোনো দিনই পাওয়া হবে না আর।