ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি। করপোরেট বাংলাদেশের বিশ্বযাত্রায় এক অনন্য নাম, দেশের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও গর্ব। দেশের মাটিতে সবুজঘন পরিবেশে তৈরি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পণ্যসামগ্রী এশিয়া মহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ওয়ালটন তা পৌঁছে দিচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে।
এই অগ্রযাত্রায় নতুন পালক যোগ করছে বিশ্বের নামি-দামি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আসা ওয়ালটনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এবার বিজয়ের মাসে নতুন বিশ্বস্বীকৃতি এসেছে ব্লুমবার্গের কাছ থেকে। এই অর্জনকে দেশের জন্য খুবই ভালো খবর মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের ক্যাপিটাল মার্কেটের বিনিয়োগ বৈচিত্রের নানা দিক নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘বিগ ডেটা’ বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী মিডিয়া ব্লুমবার্গ। টেকসই উন্নয়নের দিক থেকে যেসব কোম্পানি অবদান রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, বিশ্বজুড়ে সেইসব কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ।
মহান বিজয়ের মাসের ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ব্লুমবার্গের মর্যাদাপূর্ণ এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ। টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখা বাংলাদেশের মাত্র ১০টি কোম্পানি রয়েছে তালিকায়, যার মধ্যে রয়েছে ওয়ালটন। সপ্তম অবস্থানে থাকা ওয়ালটন এই তালিকায় আরো ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্লুমবার্গের তালিকায় স্থান করে নেওয়ার এই অর্জন বাংলাদেশের জন্য বড় সুখবর। এতে করে দেশীয় কোম্পানির যেমন বৈশ্বিক স্বীকৃতি এলো, তেমনি বড় বড় বিনিয়োগ পেতেও তা সহায়ক হবে।
ওয়ালটনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রেফ্রিজারেটর দেশের মানুষের মন জয় করে এখন বিশ্ববাজারে নন্দিত। ইলেক্ট্রনিক, ইলেকট্রিক্যাল, হোম অ্যান্ড কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স, যানবাহন ও টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে অসংখ্য পণ্য তৈরি করে দেশের সুনাম বিশ্বে তুলে ধরেছে ওয়ালটন।
তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখা ১০০টি দেশের ১৬ হাজার কোম্পানিকে বাছাই করে তালিকা তৈরি করেছে ব্লুমবার্গ। এনভায়রনমেন্টাল অর্থাৎ পরিবেশগত, সোশ্যাল অর্থাৎ সামাজিক ও গভর্নেন্স অর্থাৎ সুশাসনমূলক- এই তিনটি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে প্রস্তুত তালিকায় উঠে এসেছে ওয়ালটনের নাম। এই তিনটি বিষয়কে একসঙ্গে বলা হয়-ইএসজি।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ওয়ালটনসহ যেসব কোম্পানি ব্লুমবার্গের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ইন্ডেক্সে জায়গা করে নিয়েছে, তারা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনলো।”
“ব্লুমবার্গের মনিটর বা রিপোর্টি বা ইনডেক্স বা মতামত বিশ্বজুড়ে ফলো করা হয়। ওয়ালটন আগেই দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশে একটি নতুন শিল্পকে কীভাবে স্থাপন করা যায়। বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক-ইলেক্ট্রোনিক্স ও ম্যানুফ্যাকচ্যারিং শিল্প স্থাপন করে তারা বাংলাদেশের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ওয়ালটন তাদের কাজ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করছে।”
মাশরুর রিয়াজ বলেন, “বাংলাদেশের ট্রেড, ইনভেস্টমেন্ট ও ফাইন্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্লুমবার্গের রিকগনিশন থাকলে গ্লোবাল ফান্ড পাওয়া সহজ হয়ে যায়।”
বাংলাদেশ থেকে ব্লুমবার্গের টেকসই উন্নয়ন তালিকায় ২০২৪ সালে স্থান পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে আবার চারটি বহুজাতিক ও বিদেশি কোম্পানি। আর ছয়টি কোম্পানি দেশীয়ভাবে বিকশিত, যার একটি ওয়ালটন।
২০২৩ সালে ব্লুমবার্গের এই তালিকায় ছিল মাত্র সাতটি কোম্পানি, যেখানেও একটি নাম ছিল ওয়ালটন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- ২০২৩ সালেই প্রথমবার বাংলাদেশের সাতটি কোম্পানি ব্লুমবার্গের তালিকায় স্থান পায়।
ব্লুমবার্গের টেকসই উন্নয়ন তালিকায় স্থান পাওয়ার গুরুত্ব বিশাল। মূলধন ও বিনিয়োগ বিশ্লেষক বলছেন, এই তালিকায় নাম উঠলে সেইসব কোম্পানি বিশ্বের বড় বড় তহবিল থেকে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ পাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে থাকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিংয়ে বাংলাদেশের কোম্পানির জায়গা করে নেওয়া খুব ভালো খবর। এসব কোম্পানিকে দেখে বাংলাদেশের অন্যান্য কোম্পানির অনেক কিছু শেখার রয়েছে। এসব কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে আমি স্যালুট জানাই।”
“যেসব কোম্পানি ব্লুমবার্গের খাতাতে নাম লেখাতে পেরেছে তাদেরকে পুরস্কৃত করা উচিত। কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এটা কোম্পানিগুলোর সাফল্যের একটা প্রতিফলন।”
ব্লমবার্গের ইএসজি রেটিং তালিকায় স্থান করে নেওয়া কোম্পানিগুলোকে সরকারের তরফ থেকে আরো সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন অধ্যাপক আবু আহমেদ।
তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি, এই অর্জনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এসব কোম্পানি থেকে কম ট্যাক্স নিতে পারে। এটা আমার প্রস্তাব। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আশার ক্ষেত্রে এসব বিষয়গুলো দেখা হয়।”
“সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করব, বিনিয়োগ করার আগে এসব বিষয়গুলো দেখা উচিত। আমার মনে হয় না, এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।”
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকার বিশেষ কিছু কারণের কথা বলেছে ব্লুমবার্গ। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন সিএফসিমুক্ত রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে, এমনকি চীনের চেয়েও এগিয়ে।
পরিবেশবান্ধব কর্মপরিবেশ ও উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ওয়ালটন। হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের সবুজ কর্মপরিবেশ, সোলার প্যানেল থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে ফ্যাক্টরি পরিচালনা টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখা দুটি বড় খাত।
কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কথা বলেছেন ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির হেড অব ইএইচএস ও সাসটেইনবিলিটি কো-অর্ডিনেটর মোস্তাফিজুর রহমান রাজু।
গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির বিষয়ে তিনি বলেন, “ওয়ালটন সবসময় পরিবেশবান্ধব উপায়ে এবং টেকসই পদ্ধতিতে সুনামের সঙ্গে পণ্য উৎপাদন করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। টেকসই উৎপাদন পদ্ধতির দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো কার্বন ফুটপ্রিন্ট উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে ওয়ালটন। বর্জ্য পানি পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছি।”
কর্ম ও পণ্যবাজারকে টেকসই সামাজিক উন্নয়নের পথে ধাবিত করা ওয়ালটনের আরেকটি বড় উদ্যোগ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিক থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে ওয়ালটন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার সোলার প্যানেল স্থাপন করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে ওয়াটন। প্রতিটি সেক্টরে আমরা টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যকর করেছি। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় কর্মীদের সচেতন করা হয়। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং ওয়েলফেয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা হয়। একই সঙ্গে কার্যকর সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।”
বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ রোধ, যথাযথ কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে কর্মীদের পরিবেশগতভাবে সচেতন করার কাজটি নিয়মিতভাবে করে থাকে ওয়ালটন। একইসঙ্গে জলবায়ু সহনশীলতার কথা বিবেচনায় রেখে অফিসিয়ালি ই-যানবাহন ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে বাংলাদেশের এই করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
প্রকৃতিবিনাশী কাগজ যতটা সম্ভব কমিয়ে পেপারলেস অফিস ম্যানেজমেন্ট দাঁড় করানোর ক্ষেত্রেেও একটি অগ্রগামী করপোরেট প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন।
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে পেপারলেস ব্যবস্থা গড়ে তুলে কাগজের ব্যবহার অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছ ওয়ালটন। কারখানায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক শতভাগ রিসাইকেল করা হয়।”
টেকসই উন্নয়নে বর্তমানের নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি ভবিষ্যতেও এই সাফল্য ধরে রাখতে এবং ইএসজি রেটিং আরো বৃদ্ধি করতে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি যুগোপযোগী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে-
>> ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা। >> ৫ শতাংশ জিএইচজি নির্গমণ হ্রাস করা। >> ৭০ শতাংশ বর্জ্য পানি পুনর্ব্যবহার করা। >> ৫ শতাংশ ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট হ্রাস করা। >> সব ধরনের কাগজ ব্যবহারের পরিবর্তে শতভাগ ডিজিটালাইজেশন করা। যেমন- ই-রিকুইজিশন সিস্টেম, ই-পারমিট সিস্টেম এবং অন্যান্য ই-সার্ভিসেস। >> সিএফসি টাইপ রেফ্রিজারেন্ট শতভাগ ফেজ আউট করে হাইড্রোকার্বন-ভিত্তিক রেফ্রিজারেন্ট যেমন আর-৬০০এ, আর-২৯০, আর-৩২ বাজারে ছাড়া। >> কারখানায় আরো কমপক্ষে ২০ হাজার গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করা। >> গ্লোবালি সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং। >> পরিবেশগত ইফেক্ট হ্রাস করা। >> কার্যকর রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা। >> পরিবেশসম্পর্কিত সচেতনতা এবং মনিটরিং বৃদ্ধি করা। >> শক্তির খরচ কমাতে ইকোনোমাইজার, ভিএফডি ও অন্যান্য এনার্জি ইফিসিয়েন্ট প্রযুক্তি ইনস্টল করা। >> কার্বন, প্লাস্টিক ও অন্যান্য গ্রিন ক্রেডিট বাস্তবায়ন করা। >> আরও বেশি স্টেকহোল্ডার এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। >> আরো উচ্চ এনার্জি রেটিং-সমৃদ্ধ পণ্য উত্পাদন করা।
ওয়ালটনসহ ১০টি কোম্পানির ব্লুমবার্গের টেকসই উন্নয়ন তালিকায় থাকার ঘটনাকে বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো খবর বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।
রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “এই স্বীকৃতি শুধু দেশের লোকাল ইনভেস্টর না, বরং গ্লোবাল ইনভেস্টরদেরকেও এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগে বিষয়ে আগ্রহী করে তুলবে। এতে কোম্পানিগুলো বাজারে আরো ভালো দাম দেখতে পাবে।”
“সুতরাং পুঁজিবাজারে অন্যান্য যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে বা ভবিষ্যতে যারা তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে, তাদের জন্য এটা একটা বড় ধরনের এনকারেজিং পয়েন্ট। তারা যদি এই সাস্টেইনেবল রেটিংয়ে আসতে পারে, তারা নিজেরাই হাইলাইটেড হতে পারবে।”
টেকসই কোম্পানিগুলো নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানির পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে মমিনুল ইসলাম বলেন, “এ বিষয়ে ডিএসইর একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে। আগামীতে শীর্ষ ১০টি কোম্পানিকে সাস্টেইনেবল বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা হবে। যাতে আমরা এগুলো বিভিন্ন বিনিয়োগকারী গ্রুপের কাছে শোকেসিং বা প্রদর্শন করতে পারি।”
“দেশের ভেতরে ইনস্টিস্টিউশনাল বা হাইনেটওয়ার্ক বা রিটেইল কাস্টমার বা গ্লোবাল ইনভেস্টদের কাছে এদেরকে হাইলাইট করা হবে। এভাবেই আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”
ওয়ালটনসহ যেসব কোম্পানি ব্লুমবার্গের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে চান ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। এটি করতে পারলে ভালো ফল পাওয়ারও আশা করছেন তিনি।
মমিনুল ইসলাম বলছেন, “দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আশার ক্ষেত্রে ব্লুমবার্গের রিকগনিশন অবশ্যই বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। তবে এটাই একমাত্র নিয়ামক নয়, আরো কিছু বিষয় রয়েছে। তবে আমরা এটা কীভাবে আরো প্রচার-প্রসারে আনতে পারি সেইটা একটা বিষয়। সে জন্য প্রতিবছর আমরা একটা ইনভেস্টমেন্ট সামিট করতে চাচ্ছি। সেসময় আমরা এই অ্যাওয়ার্ডগুলো দিব, যারা সবচেয়ে টেকসই কোম্পানি হিসেবে জায়গা করে নেবে, তাদের দেব। যেটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
“এতে সকল ইনভেস্টররা ধারাবাহিকভাবে এই কোম্পানিগুলোকে ভালোভাবে নোটিশ করতে পারবে। তাই আমরা আশা করি, এটি সেই সময়ে আরো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ এখনও বাংলাদেশে কেউ বিনিয়োগে আসতে চাইলে তারা সবার আগে ব্লুমবার্গের ইন্ডেক্সে জায়গা করে নেওয়া কোম্পানিগুলোকে সবার আগে নোটিশ করে থাকে,” যোগ করেন ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।
ইএসজি কমপ্লায়েন্স গ্রহণ ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি দেশের অব্যাহত চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওয়ালটন। সামগ্রিকভাবে ওয়ালটনের এই কর্ম-উদ্যোগ জলবায়ু সহনশীল উৎপাদন ব্যবস্থায় নজির স্থাপন করেছে।
জলবায়ু, পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা, প্রকৃতি ও মানুষের মাধ্যমে ‘নেট-জিরো’ কার্বন-নিঃসরণ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে ওয়ালটন।
শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনে এবং সবুজ (গ্রিন) ও টেকসই বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাকে জোরদার করছে ওয়ালটন।
ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলছেন, “আমরা রেগুলেশন করে সবসময় প্রত্যাশিত রেজাল্টটা পাচ্ছি না। কিন্তু এই শোকেসিং করে আমরা বেটার রেজাল্ট পাবো বলে আশা করছি।”
“যেসব কোম্পানি ব্লুমবার্গের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ইন্ডেক্সে জায়গা করে নিয়েছে, তাদের দেখে অন্যান্য কোম্পানির অনেক কিছু শেখার আছে; যা তাদের কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, সুশাসন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের পাশাপাশি ২০২৪ সালের জন্য ব্লুমবার্গের টেকসই তালিকায় উঠে আসা অন্যান্য কোম্পানিগুলো হলো- বিএটি বাংলাদেশ (বিএটিবি), গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, ব্র্যাক ব্যাংক, আইডিএলসি ফাইন্যান্স, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বিএসআরএম, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ ও এমজেএল বাংলাদেশ।
শীর্ষস্থানীয় ইএসজি রেটিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ব্লুমবার্গ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে থাকে তারা। পরিবেশগত, সামাজিক ও শাসনের (ইএসজি) নানান বিভাগের ভিন্নভিন্ন মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।
অর্থনীতিবিদ এম মাশরুর রিয়াজ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরা যদি এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্নেন্স (ইএসজি) উন্নত না করি বা স্ট্যান্ডার্ড না বাড়াই তাহলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ ও যৌথ বিনিয়োগ টানা কঠিন হয়ে যাবে।”
“কারণ বিদেশে যারা আমাদের থেকে পণ্য ক্রয় করতে চায় বা যারা বিনিয়োগে আসতে চায় বা যারা আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায়, তারা নিজেরা তাদের শেয়ারহোল্ডাররা বিশ্বের বিভিন্ন আইন-কানুনের নিরিখে একটি স্ট্যান্ডার্ডের নিচে আসতে পারবে না। সুতরাং আমরা যদি ট্রেড ও ইনভেস্টমেন্ট আকৃষ্ট করতে চাই তাহলে এই ইএসজি সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং সেটার পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।”
“সেদিক বিবেচনায় আমাদের যে ১০টি কোম্পানি ব্লুমবার্গের তালিকায় সংযুক্ত হতে পেরেছে, এর মাধ্যমে তারা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। তার মানে এটা বাংলাদেশের অন্যান্য কোম্পানিগুলোর পক্ষেও করা সম্ভব। সুতরাং এখন থেকে আমাদের এটাই শিক্ষা নিতে হবে যে, বাংলাদেশে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ব্যবসা করেও বিশ্বমানে নেওয়া সম্ভব; যা এসব কোম্পানির কার্যক্রমে উঠে এসেছে,” যোগ করেন মাশরুর রিয়াজ।
ব্লুমবার্গের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ইন্ডেক্সে জায়গা করে নেওয়া মানে সুনাম বৃদ্ধি পাওয়া- এমনটি মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, “এই সুনাম ব্যবসার একটি বড় ক্যাপিটাল বা গুডউইল বা পূর্বশর্ত। যেকোনো কোম্পানির জন্য তাদের সুনাম বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা হতে পারে একটি বড় উদাহরণ।”
“এ কোম্পানিগুলো সবই বড় ও মাল্টিন্যাশনাল। তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। তবে অন্যান্য কোম্পানির সক্ষমতা বেশি নাও থাকতে পারে। সুতরাং যারা মাঝারি আকারের কোম্পানি বা লোকাল কোম্পানি রয়েছে, তাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে যেতে যে ধরনের পলিসি সাপোর্ট দরকার, তা সরকার ভেবে দেখতে পারে।”
ব্লুমবার্গ তথ্য অনুযায়ী, ইএসজি রেটিংপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক ইক্যুইটি বাজার মূলধনের ৯৪ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এখনও বিশ্বের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই বৈশ্বিক ৬০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ীও বটে।
ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কোম্পানি বেশি। তবে এবার তালিকায় বাংলাদেশ থেকে তিনটি কোম্পানি বেড়েছে, যাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলছেন, “ব্লুমবার্গের লিস্টে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত বা পাকিস্তানের অনেক বেশি কোম্পানি রয়েছে। তবে ব্লুমবার্গের লিস্টে আগের চেয়ে বাংলাদেশি কোম্পানির সংখ্যা যে বাড়ছে, এটা অনেক খুশির খবর। এসব কোম্পানি অ্যাকাউন্টেবিলিটি ও ট্রান্সপারেন্সিতে বিশ্বাস করে। তাই কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।”
“পুঁজিবাজার বা পুঁজিবাজারের বাইরে যেসব কোম্পানি রয়েছে, তারা এসব কোম্পানিকে দেখে শিক্ষা নিতে পারে। অন্যান্য কোম্পানি যদি তাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে তারাও ব্লুমবার্গের তালিকায় সংযুক্ত হতে পারবে,” যোগ করেন অধ্যাপক আবু আহমেদ।