বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিতে আহত হন খুলনা সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম শিকদার। গত ৪ আগস্ট খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এরপর একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নাঈমের শরীরে থাকা তিন শতাধিক বুলেট বের করা সম্ভব না। সারাজীবন বুলেট নিয়েই চলতে হবে তাকে।
নাঈমের বাবা মালেক শিকদার বলেন, ‘‘চার মাসের বেশি সময় হয়ে গেছে নাঈম ঠিকমত ঘুমোতে পারে না। সারাক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। শরীরের থাকা তিন শতাধিক বুলেটে সব সময় যন্ত্রণা করে। বাবা হয়ে এই দৃশ্যে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের? কিন্তু, কি করব? চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, নাঈমের শরীরে থাকা বুলেট বের করা যাবে না।’’
এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমার বাপটা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল।’’
গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে নাঈম জানান, তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। প্রতিদিনই বাড়িতে খেলার কথা বলে যেতেন শিববাড়ি। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসত সেটাই পালন করতেন।
তিনি জানান, গত ৪ আগস্ট বিকেলে শহরের শহীদ হাদিস পার্ক থেকে মিছিল নিয়ে কাস্টম ঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বাসভবনের সামনে গেলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করা হয়। টিয়ারসেলে চোখ বন্ধ হয়ে যায় নাঈমের। পরে সড়কের পাশের একটি বাড়ি থেকে টুথপেস্ট ও ঠাণ্ডা পানি দিলে তা চোখে-মুখে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকেন। এ সময় সঙ্গে থাকা হ্যান্ডমাইক দিয়ে এক ছাত্রনেতা পুলিশকে গুলি না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘আপনারা আমাদের ওপর গুলি করবেন না। আমরা আপনাদের কিছু বলব না।’’ এরপর পুলিশ গুলি থামালে ছাত্ররা তাদের কাছাকাছি যায়।
নাঈম বলেন, ‘‘কথা বলার একপর্যায়ে হঠাৎ পুলিশ গুলির জন্য বন্দুক তাক করে। তাদের প্রস্তুতি দেখে ঘুরে যাওয়া মাত্রই পিঠ লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি ছুঁড়ে। এরপর আর কিছু মনে নেই।’’
নাঈমের মা মোরশেদা বেগম জানান, মাগরিবের পর অজ্ঞাত নম্বর থেকে কল আসে নাঈমের বাবার কাছে। ফোন রিসিভ করার পর অপর প্রান্ত থেকে গুলির বিষয়টি জানানো হয়। দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, নাঈমকে তৃতীয় তলার একটি ওয়ার্ডে ফেলে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা গুলিবিদ্ধ রোগীর চিকিৎসা করতে চাচ্ছিলেন না। এ সময় হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগ নেতা সুজনের (আওয়ামী লীগ অফিসে ছাত্র-জনতার হামলায় আহত হন) লোকজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ভয়ে নাঈমকে ঢেকে রাখা হয়।
তিনি বলেন, ‘‘ভর্তির পরদিনই আমাদের হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাল্টে যায় চিত্র। চিকিৎসায় ফিরে আসে গতি। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাঈমকে রাখা হয় ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর খালিশপুর উপশম হাসপাতাল, সেখান থেকে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর ছাড়পত্র দিলে নাঈমকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।’’
মোরশেদা বেগম বলেন, ‘‘চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী আবার নাঈমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর ছাড়পত্র দেওয়া হয়।’’
‘‘চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, নাঈমকে ওষুধের ওপর চলতে হবে। শরীরে অন্তত তিন শতাধিক বুলেট রয়ে গেছে। যা বের করা সম্ভব নয়। এর ফলে, শরীরের অনেক শিরা নষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য সব সময় যন্ত্রণা করে।’’ - যোগ করেন তিনি।
নাঈমের বাড়ি খুলনা নগরীর দৌলতপুরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আঞ্জুমান রোডে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে মেজ। অভাবের সংসারের হাল ধরেতে লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি ও রং মিস্ত্রির কাজ করতেন নাঈম। কিন্তু, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সে পথ বন্ধ। বৃদ্ধ বাবা ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
নাঈমের বাবা মালেক শিকদার বলেন, ‘‘শুনেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সহায়তায় তালিকা করেছে সরকার। কিন্তু, এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে সামান্য আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছি।’’
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফারুখে আযম মু. আব্দুস ছালাম বলেন, ‘‘নাঈমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে কলেজের পক্ষ থেকে সার্বিক খোঁজ রাখা হচ্ছে। তার চিকিৎসার ব্যাপারেও শিক্ষকরা সহযোগিতা করেছেন।’’