ভোর সাড়ে তিনটায় এলার্ম বেজে উঠল। আজকে পরীক্ষার দিন- রেইস ডে। আগের দিন খাবার-দাবার নিয়ে বেশ গবেষণা হয়ছে। রাফাত আর আতাউর ভাই ভাত ডিম খাবে, নাহিদ কলা রুটি, খেজুর; সামিউল ভাইয়ের রুমে গিয়ে দেখি চিকেন শরমা, ভাত-মাংস দিয়ে মাখানো গোল্লা সব টেবিলে সাজিয়ে রেডি করে রাখা। তিনি অবশ্য ফুল আয়রনম্যান দেবেন। এ কারণে তাদের প্রস্তুতিপর্ব আরো নিখুঁতভাবে করতে হয়।
ফুল যারা দেবেন তাদের এক্সট্রা ব্যাগ দেওয়া হয় রেইসের মধ্যে নিজের খাবার বা প্রয়োজনীয় হাইড্রেশন যেনো রেডি রাখতে পারে। নির্দিষ্ট জায়গায় তা সময়মত পৌঁছে দেওয়া হয়। আমিও একটা শরমা নিলাম। পেলাঙি হোটেলের নিচে একটা টার্কিস শরমা হাউজ ছিল, সেখানে সিলেটের এক ভাই শরমা বানায়। বেশ কয়েকবার সেখানে খেয়েছি, তাই আর অন্য কিছুতে গেলাম না।
আজকের দিনের প্রতিটি সময় গুরুত্বপূর্ণ। বিছানা থেকে জলদি উঠে ফ্রেশ হয়ে গরম পানি দিয়ে মধু পান করলাম, এরপর শরমা খেলাম। হাতে কিছু সময় থাকলো যদি পেটে চাপ আসে এবং খাবারটাও হজম হয়। সব রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু হাতে লাগানোর জন্য বিব নাম্বারটা কোথায় হারিয়ে ফেললাম। যদিও মার্কার দিয়ে লিখে দেবে তারা। গায়ে বিডিট্রাই এর জার্সি পরে নিলাম, ভোরবেলা হাল্কা ঠান্ডা লাগে তাই জ্যাকেটও চাপালাম। সুইমিং গ্লাস আর ক্যাপ সঙ্গে নিলাম। একটা কালো ব্যাগ দিয়েছিল তাতে বিব নাম্বার লাগানো আছে, সেখানে পাম্পার, সাইকেল পরিষ্কার করার জিনিসপত্র, সেন্ডল রেখে আরেকটা গাড়িতে ফেলে দিতে পারবো। রেইস শেষে পুনরায় সংগ্রহ করে নিতে হবে।
জুতা আগেই টি-টুতে রেখে এসেছিলাম, তাই একটা স্লিপার কিনে নিয়েছিলাম ১০ রিঙ্গিত দিয়ে। ৫টার মধ্যে সাকলাইন ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির চেনাং ভিউয়ের সামনে। হাফিজ মালয়েশিয়ার দক্ষ ড্রাইভার। সাকলাইন ভাই কয়েক বছর থেকে তাকে সঙ্গে রাখছেন। ইংরেজিতে ভালোই কথা বলতে পারে। আমাদের রেগুলার রুট ছেড়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলো হাফিজ। কারণ রেইসের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আয়রনম্যান আয়োজনের জন্য আজকে সব কিছু শিথিল করা হয়েছে। লানকাউইতে আজকে সাজ সাজ রব! পুরা শহর জেগে উঠবে প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য।
এক ঘণ্টা লাগলো ‘ডানা লানকাউই’ পৌঁছাতে। তখনো আকাশে আলো ফোটেনি। শাটল বাস একের পর এক আসছে প্রতিযোগী আর তাদের সঙ্গীদের নিয়ে। রেইসের সময় মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি নেই তাই সঙ্গী সাথীদের কাছে অনেকে তা রেখে যাচ্ছে যেনো কাছাকাছি দেখা পেলে ছবি তুলতে পারে। গতকাল যেখানে সাইকেল রেখে এসেছিলাম প্রথমে সেখানে চলে গেলাম। বৃষ্টি হয়েছে রাতে, সাইকেল ভালোমতো মুছে চেইনে লুব দিলাম। হাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলাম, যেনো রোদে অতিরিক্ত গরমে টিউবের ক্ষতি না হয়। রাফাত বড় পাম্পার নিয়ে এসেছে; সেটা দিয়ে সবার কাজ হয়ে গেলো। সবার সাইকেল কাছাকাছি জায়গায় ছিল তাই একে অন্যের সহোযোগিতা করতে সুবিধে হলো। ফ্লাডলাইটের আলো আর লাউড মিউজিক শরীর মনকে চনমনে রাখছে। ওদিকে সময় কমে আসছে, মাইকে বারবার বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক চিপ পেয়ে গেলে ধীরে ধীরে সমুদ্র সৈকতের স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে চলে আসতে।
সূর্যের আলো ফোটার পরেই প্রথম ব্যাচ সাঁতার শুরু করবে। আমার ক্যাপের রং নীল, সময় ৫০ মিনিট। লাল রঙের ক্যাপ যারা তাদের আরো দশ মিনিট কমে সাঁতার শেষ করতে হবে। আর সাদা ক্যাপ যাদের তারা সময় পাবে ১ ঘণ্টা ১৫মিনিট। গ্যাপ দিয়ে দিয়ে প্রতিযোগীদের পানিতে নামতে হবে, না হলে ভজঘট লেগে যাবে। একে অন্যের গায়ের উপর পড়বে বা হাত-পা লেগে আহত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
পায়ে চিপ পরিয়ে দেওয়ার পর গুটিগুটি পায়ে আগাতে লাগলাম। রাস্তায় লাইন ধরে টেম্পরারি টয়লেট রাখা রয়েছে, সুন্দর ব্যবস্থা! চাইলে কাজ সেরে নিতে পারে। কালো ব্যাগটা গাড়িতে দিয়ে সৈকতের বালুতে পা দিলাম। এখন আমি শুধু আমাতে আছি, এই যাত্রা শুধু আমার, আমাকেই একা সবকিছু শেষ করে ফিনিশ লাইনে দাঁড়াতে হবে এবং সবকিছু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। একে একে লাল ক্যাপ পরা প্রতিযোগীদের ডেকে নিচ্ছেন স্টার্ট পয়েন্টের দিকে। মাইকে উৎসাহ উদ্দিপনামূলক কথা বলে সাহস বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথমবারের অনুভূতি সবসময়ই অনন্য। কেমন জানি একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে। আমারও ডাক পড়লো, সবার সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশ্বের কত দেশের মানুষ একত্র হয়েছে। অনেকের আয়রনম্যন দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আমার পাশে জার্মানির এক তরুণ, সেও প্রথমবার বেশ উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল! আমরা পরিচিত হয়ে নিলাম। আরেকজন বেশ কয়েকবার আয়রনম্যান দিয়েছেন। তিনি বললেন, দুই-তিন বার হাফ দেওয়ার পর ফুল আয়রনম্যানের জন্য যাওয়া উচিত। এটা সত্যি কঠিন কাজ।
জেসনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো, মালয়েশিয়ার বাসিন্দা। চারবার হাফ আয়রনম্যান আর একবার ফুল দিয়েছেন। বয়স ৫০ এর উপরে। এক্সপোতে পরিচয় হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বেশ উৎসাহ দেখিয়েছিল। আজকের জন্য শুভ কামনা আর সাহস দিলো। ভেতরটা ধুকপুক করছে, আমাদের সময় এলে বাঁশি বাজানো মাত্র ঝাঁপ দিলাম সমুদ্রে। আমার সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেলাম তাই দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দড়ি দিয়ে সীমানা করে দেওয়া আছে, বিশাল আকারের হলুদ বয়া তাতে বাঁধা, কায়াকে ভলান্টিয়াররা ঘুরছে আর কেউ লাইন ক্রস করলে বাশি বাজিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে। কেউ ক্লান্ত অনুভব করলে বয়া ধরে বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি আছে।
আজকে থামার বা স্লো হবার কোনো অবকাশ নেই। প্রাণপণ সাঁতার কেটে যাচ্ছি, কেউ কেউ হাতে-পায়ে বাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। আমি কখনো এগিয়ে যাচ্ছি অথবা সরে যাচ্ছি। সবাই দিশেহারার মতো শুধু হাত-পা ছুড়ছে। সাঁতারের প্রস্তুতি ভালোই নিয়েছিলাম, তাও মনে হচ্ছিল আমার দম কমে আসছে, পথ আর কত দূর বাকি? বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার সময় তামিম আমাকে বলেছিল- ভাই যে সংখ্যা মাথায় আসে গুনতে থাকবেন, তাতে করে একঘেঁয়েমি কাজ করবে না। আমি মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলতে সংখ্যা গোনা শুরু করলাম, ২০, ২১, ২২, ২৩ যা ইচ্ছে তা। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি সামনে বিচ দেখা যাচ্ছে, এই তো পেরে গেলাম!
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৪৭ মিনিটে সাঁতার শেষ করলাম। আমার টার্গেট সময়ের আগেই শেষ হলো। জাহিদ ভাইয়ের গার্মিন ওয়াচ আর হেলমেটের জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার জিনিসগুলো আয়রনম্যান ঘুরে এলে তিনিও তৈরি হবার অনুপ্রেরণা পাবেন।
সাঁতার থেকে উঠে মাথা ভনভন করছিল। টি-ওয়ান এ ব্যাগের কাছে গিয়ে খেই হারিয়ে মাথার ক্যাপ কোথায় ফেলে দিলাম! পানি খেয়ে নিজেকে ঠিক করে, ব্যাগে রাখা টাওয়াল দিয়ে গা মুছে জুতা মোজা পরে নিলাম। চশমা, ওটস বার সব জার্সিতে গুজে মুখে সানস্ক্রিন, গায়ে ভেজলিন লাগালাম। টেবিলের উপর সব রাখা আছে। সুইমিং ক্যাপটা মাটিতে খুঁজে পেলাম, চশমা আর ক্যাপ সেই ব্যাগে রেখে সাইকেলের দিকে ছুটলাম। এর মধ্যে ১০মিনিট চলে গেলো চোখের পলকে।
একে ট্রানজিশন টাইম বলে, যা মোট সাড়ে আট ঘণ্টার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সাইকেলে হেলমেট রাখা ছিল, চশমা হেলমেট সব কিছু ঠিকঠাক দেখে নিয়ে ডানা থেকে রাস্তায় উঠে মনে পড়লো হ্যান্ড পাম্পারটা ব্যাগে ফেলে এসেছি। সিও টু কার্টিজ যা দ্রুত হাওয়া দিতে কাজে লাগে তাও কেনা হয়নি। এখন উপরওলাই একমাত্র ভরসা। কারণ পথে লিক হলে রেইস কর্তৃপক্ষের সাহায্যের আশায় বসে থাকলে সময় সব ফুরিয়ে যাবে।
শুরু করলাম যাত্রা, সাঁতারের পর সাইকেলে ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগলো।
পড়ুন ২য় পর্ব : এক বছরের সাধনার চরম পরীক্ষা