ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরের স্বতন্ত্র কার্যক্রম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল না।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ ছিল। ‘জোর যার মুল্লুক তার’-নীতিতে তারা ক্যাম্পাস থেকে ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন দমন করেছে। তারা আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিলাসী জীবনযাপন, ছাত্রী হেনস্তাসহ নানা অপকর্ম করেছে। হলগুলোতে টর্চার সেল বানিয়ে ভিন্নমতের ছাত্রদের আটকে রেখে নির্যাতন করতো।
ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে সহাবস্থান বলতে কিছু ছিল না। আধিপত্য বিস্তার এবং নেতৃত্বের কোন্দলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। হলগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অন্য শিক্ষার্থীরা থাকতেন তটস্থ।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর পর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিবর্তনের ঢেউ লাগে।এ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা না করার বিষয়টি এখন আলোচনার মূলকেন্দ্র।
এ নিয়ে অকপটে বলতে হয় ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ’। অনেকেই মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই. কিন্তু ছাত্র রাজনীতি থাকা চাই। এ ক্ষেত্রে নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ চালু করা সময়ের দাবি। অধিকার আদায় করতে রাজনীতির প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী এ কথা বেশ বলা হয়। কিন্তু আদতে তা যথাযথ প্রক্রিয়া?
কেননা, আমরা দেখতে পাই অধিকার আদায়ে ছাত্র রাজনীতির বিকল্প নেই- এমন বুলি আওড়িয়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেন। রাজনৈতিক দলের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা ছাত্র রাজনীতি করেন এবং নেতৃত্বের আসনে বসে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালান। তাদের বিরূদ্ধাচারীদের বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে হামলার বৈধতা নেন। এতে অনেক ছাত্র পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যান। ফলে তারা রেজাল্ট খারাপ করাসহ ফেলও করছেন। অনেকে চার বছরের অনার্স কোর্স সাত বছরেও শেষ করতে পারেন না।
একদিকে নানা নীতিবাক্য বলে নিজের জীবনের অঙ্গহানি তো করেই পাশাপাশি অন্যের জীবনেরও বারোটা বাজিয়ে দেন। ছাত্র নেতাদের অনেকে রাজনীতির মওকা নিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য করে অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। অনেকের কাছে প্রতিষ্ঠিত ও ধনী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার ছাত্র রাজনীতি।
দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে অনেক সময় ক্যাম্পাসে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এতে সেশনজটসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেশনজটে পড়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে অতিরিক্ত যে সময় ব্যয় হয়, তা কিন্তু একজন ছাত্রের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-সংসারসহ সবকিছু তার দেরিতে শুরু হলো।
এমন রাজনীতি পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল পড়াশোনা আর গবেষণা চলে। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায় ও সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক রাজনীতি করে।
ছাত্রজীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কর্মজীবন গড়ার ভিত্তি। পড়াশোনা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করাই হবে শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ। শিক্ষার মান বাড়ানো, নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া, আবাসিক সমস্যার সমাধান ইত্যাদি দাবি আদায়ে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং কাজ করবে। ছাত্রদের উদ্যোগে বিতর্ক, গানের আসর, কবিতা আবৃত্তি, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হবে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার বিকাশ হবে, তারা সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
অনেকে হয়তো বলবেন, বিগত যেকোন আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্ররাই সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছে। তারা নানা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলবেন ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বৈরাচারের কবল থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে। যেখানে নেতৃত্বের মূলে থাকা সমন্বয়কদের কোন না কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। তাই এ দেশের রাজনৈতিক ভাবধারানুযায়ী কিভাবে শিক্ষাঙ্গান থেকে ছাত্র রাজনীতি বাদ দেওয়া যায়?
তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এ আন্দোলন ছাত্রদের নেত্বত্বে গড়ে উঠেছে যতটুকু সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য- সমন্বয়করা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে জাতীয় অধিকারের স্বার্থে কাজ করেছে। এতে দেখা যায়, যৌক্তিকভাবে অধিকার আদায়ে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির প্রাধান্য প্রচ্ছন্ন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে তরুণ সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের মাইনাস করে জাতির সমৃদ্ধি চিন্তা করা অকল্পনীয়। ছাত্র রাজনীতি বিদ্যমান থাকা অবশ্যম্ভাবী। তবে নতুন এ পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থীর যদি রাজনীতি করতেই হয়, তাহলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ও প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতি পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণা নির্ভর ক্যাম্পাস গড়ে তোলার রাজনীতি চালু করতে হবে।
এজন্য শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাজের রোডম্যাপ থাকা সময়ের দাবি। তাদের কার্যক্রমের রূপরেখায় নিশ্চিত করতে হবে, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সংগঠনের ন্যায় আর কোনো ছাত্র সংগঠন কাজ করবে না। তারা মানসম্মত উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ, নতুন নতুন বিষয় ও পদ্ধতির উদ্ভাবন, প্রয়োগযোগ্য বাস্তবজ্ঞান এবং উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির রাজনীতি করবে।
ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যার সমাধান কেন্দ্রিক রাজনীতি চালু থাকবে। এজন্য চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ন্যায় ঐক্যবদ্ধতাই যথেষ্ট। যেখানে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জগদ্দল পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বৈরশাসনের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। সর্বোপরি, একটি জ্ঞাননির্ভর প্রজন্ম গড়ে তোলার রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়