আমাদের দেশের মানুষ ভোটকে ‘উৎসব’ বলে মনে করে। ভোটের সময় দেশের গ্রাম-গঞ্জে গেলে বোঝা যায় এ দেশের মানুষ এই উৎসবে কতটা আগ্রহ নিয়ে সামিল হন। ভোট আসলে মেতে ওঠে তারা। সারাদিন ভোটের আলাপ-আলোচনা। চায়ের দোকান, হাটবাজার, মাঠ-ঘাট, অলিগলি, পাড়া মহল্লা সরগরম!
কীভাবে নিজের প্রার্থীর পক্ষে ভোট আনা যায়, নিজের প্রার্থীকে উপরে রাখা যায়, এ নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকে। ভোট না করলে বাঙালির যেন অনেক অপূর্ণতা থেকে যায়। মানুষ জমি, সম্পত্তি বিক্রি করে, ঋণ করে ভোট করে এমন উদাহরণ বিরল নয়। কিন্তু ইতিহাসের নিরিখে এদেশের মানুষ ও সাধারণ ভোটারদের খুব কমই মূল্যায়ন করা হয়েছে। অধিকার তো দূরের কথা, শত্রুতে পরিণত হওয়া নানা ধরনের ঝালেমায় পড়তে হয়েছে ভোটারদের। শুধু ক্ষমতা বদলের উপায় হয়ে আসে না, এ দেশের মানুষের জীবনে ভোট আসে বিভিন্ন রূপে। ভোটার থাকতে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া, পাতানো নির্বাচন, রাতের ভোট, ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতি, ভোট ম্যাকানিজম, বন্দুকের নল, বিভিন্ন বাহিনীর অত্যাচার, ভয়ভীতি দেখিয়ে সিল মারা, ভূতুড়ে ভোট, গায়েবি ভোট, টাকা পয়সার ছড়াছড়ি, বিরোধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়াসহ অনেক ঘটনা বারবারই এ দেশের গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনও শোনা গেছে, ভোটারদের বলা হয়েছে, ‘কষ্ট করে কেন্দ্রে আসার দরকার কী?’ এরপর প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচন-পরবর্তী সংঘর্ষ, হিংসা ও প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়।
এ দেশের মানুষের প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ এসেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে বাঙালিরা প্রথম গণভোট দেয়। ভোট দিতে পেরেছিল ঠিকই, তবে এই ভোটের পর হিন্দু আর মুসলিম এলিটদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা আর কমেনি। এমন অস্থিরতার মধ্যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচন হয়। দূরত্ব বাড়তে বাড়তে বাড়তে এক সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা ঘটনা এবং ৪৭ সালে টুকরো টুকরো হয়ে যায় বাংলা।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে এ দেশের মানুষ ভোট দিতে পেরে ছিল দুই বার। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও তাদের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় থাকতে পারিনি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেটা শেষ পর্যন্ত ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।
আশা করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার আর কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু আমাদের চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা ও ক্ষমতা পরিবর্তনের সুষ্ঠু কোনো নিয়মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এক ঝামেলা চলে গেলে আর এক ঝামেলা এসে জেঁকে বসেছে।
এটাই এ দেশের বাস্তবতা যে, ক্ষমতাসীন বা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। স্বাধীন দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। নির্বাচনটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবে হয়ে ছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল। জিয়াউর রহমানের সময় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সে নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাক্রমে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের পাশাপাশি বন্দুকের নল ও বিভিন্ন ধরনের বাহিনীর সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয় এ দেশের মানুষ। এক সময় সব দল এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে এবং পতন ঘটায় যেটা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। এরশাদের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় যার অধীনে ১৯৯১ সালের নির্বাচন হয়। ঐ অন্তর্বর্তী সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলা না হলেও মডেলটা ছিল সেরকমই।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগ থেকেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ঐ সময় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল। এরপর বিএনপি ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আইন পাশ করে। তবে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন অতীত অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ২০০১ ও ২০০৮ সালে এই সরকারের গঠন নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। তবে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন মোটামুটি নিরপেক্ষ হয়েছিল এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল- এ বিষয়ে কারোর দ্বিমত থাকার কথা নয়।
২০০৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ত্রুটি দেখিয়ে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের উদ্যোগ নেন। ফলে যে তরি চড়ে আ. লীগ ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল, সেটা আর থাকল না। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ওপর ভর করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটা বাতিল করা হয়। বিরোধী দলগুলো অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এমনকি সুশীল সমাজ থেকেও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতেও ক্ষমতাসীনদের টলানো যায়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া পরপর তিনটি নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল বিরোধীদের নির্বাচনে আনতে না পারা। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি না করে দুর্বলতাগুলো দূর করে এটাকে আরও শক্তিশালী করা। সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার ও সংসদে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল খুবই আবশ্যক। আর স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান না গড়ে, সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা না করে, দেশে অসন্তোষ থাকলে কিছু যে টেকসই হয় না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই জন্য দেশে নির্দিষ্ট সময় পরপর সুষ্ঠু নির্বাচন আর ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা ভালো পরিবেশ খুবই আবশ্যক। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব-সহিংসতা-অসন্তোষ-অরাজকতা-অস্থিতিশীলতা কাম্য নয়। এগুলো বারবার ঘটতে বা চলতে থাকলে বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে একটি সংঘাতময় ও অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকেই চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গত ১৯ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। যার পেক্ষিতে গত ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা পুনর্বহালের শতভাগ নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যায়নি। কেননা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি রিভিউ বা পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে, যার শুনানি আগামী ১৯ জানুয়ারি হওয়ার কথা রয়েছে। রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার রায় পক্ষে যাওয়া ও পরবর্তী কর্মকাণ্ডের উপর পুনর্বহাল নির্ভর করছে। তবুও দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী।
এখন দেশের এটাই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তো দূরের কথা, একে অপরকে বিনাশ বা উচ্ছেদ করতে ব্যস্ত। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি লেগেই আছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্য রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ গ্রহণযোগ্য, অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ মনে করতে চায় না। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার পর, পূর্বের দেওয়া ওয়াদাগুলো রক্ষা করতে পারছে না। বিষয় এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘যে লঙ্কা যায়, সেই রাবণ হয়’। ক্ষমতাগ্রহণের পর নীতিশাস্ত্রের এমন উদহারণ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বের হতে পারছে না।
আমাদের দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনাররা সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত ও সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। কিন্তু দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়া কমিশনাররা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ও শপথ ভঙ্গ করে বিশেষ রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করেছেন। সেক্ষেত্রে অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তা ও নির্বাচনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অনেকে যুক্তি দেখান, নিরপেক্ষ কোনো মানুষ নেই। মানুষ সবসময় কোনো না কোনো আদর্শ ধারণ করে থাকে। এটা ঠিক, প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো বিশেষ আদর্শ বা মতের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে, তবে পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যা কম নেই, যারা চেয়ারে বসে নিরপেক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবরা এদেশে নিরপেক্ষতা প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলেন।
আমেরিকার মডেল, ভারতের মডেল বা অন্য দেশের মডেলের বিষয় বিবেচনা না করে, এই সবুজ-শ্যামল বাংলার জটিল মানুষের চরিত্রে কোনটা খাপ খায় সেই মডেলই গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতির এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ঐতিহাসিক সত্যের আলোকে ও বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ছোটখাট ভুলত্রুটি থাকতে পারে তবে খুনোখুনি, সংঘাতময় পরিবেশ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে যাওয়ার চেয়ে আপাতত এর বিকল্প কিছু আছে কি? ত্রুটি থাকলে বা আরও স্বচ্ছভাবে গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করে এই সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা সময়ের দাবি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী