ক্যাম্পাস

ঐতিহ্য: স্মৃতির ধুলোয় ধুঁকছে পুরান ঢাকার ক্লাবগুলো

বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী শহর পুরান ঢাকার রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মহল্লা-মহল্লায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব-সংঘ সামাজিক কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে ছিল অতুলনীয়। কিন্তু এসব ক্লাবগুলোতে নেই কর্মী, পরিচর্যা বা কোন কার্যক্রম। সমাজকে পরিচর্যা করতে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোই আজ ভুগছে পরিচর্যাহীনতায়।

সরজমিনে দেখা যায়, বাংলাবাজার রূপচাঁন দাস লেনে অবস্থিত মাহফুজ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার। পৌড় একটি বাড়ির দোতলায় ঝুলছে পরিচিতি বোর্ড। সেখানেই বড় করে লেখা ক্লাবের নাম। দেখে মনে হয় এটি যেকোন সময়ই ভেঙে পড়তে পারে। তবুও নিচ তলায় মানুষের বসবাস। দোতলায়ও বড় দুই রুম ভাড়া দেওয়া। সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই ডান হাতে একটি তালাবদ্ধ দরজা; এটিই ক্লাব! একসঙ্গে মানুষের বেশ আনাগোনা ছিল এই ক্লাবে। সামাজিক বিষয়কে প্রাধান্য করেই এর কার্যক্রম চলতো। দুস্থ মানুষদের সহায়তাসহ জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতো আশপাশের মহল্লায়। অথচ সেই ক্লাব ভুগছে জরাজীর্ণতায়।

ক্লাবটির বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ক্লাবগুলো পরিচালনা করার জন্য কোন অনুদান আসে না। তাছাড়া, যারা ক্লাবটি নিয়ে কাজ করতেন, জুলাই বিল্পবের আগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কারণে তারা কাজ করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে। এটা এখন আর ক্লাব নেই। অনেক আগে কার্যক্রম ছিল শুনেছি। কিন্তু এখন কেউ আসে না, দেখাশোনা করে না। এটার কোন নিবন্ধনই নেই এখন।

তারা আরো জানান, মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন, সামাজিকতা, মানবিকতা এখন কমে এসেছে। এছাড়া কোন অনুদান বা ভর্তুকি ক্লাবে আসে না। ক্লাবে খেলাধুলার সারঞ্জাম থাকলেও তা সীমিত পর্যায়ে। মাত্র দুই-একটি ক্লাবের মাঠ থাকলেও বাকিগুলো ‘ভাড়ে মা ভবানি’। অনেক জায়গায় যথাযথ পরিচর্যা না থাকায় বন্ধের পথে। কোনটি আবার শুধু নামেই ক্লাব, বাস্তবে সেখানে ভাড়া দিয়ে থাকছেন শ্রমিকরা।

সরেজমিনে পুরান ঢাকার মাহফুজ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার, মুক্তি খেলাঘর আসর, কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাব, মুরগিটোলা যুব সংঘ, দক্ষিণ মৈশুণ্ডি যুব ক্লাব, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবসহ আরো কয়েকটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। অনেক কাছ থেকে শোনা যায়, পূর্বে এ ক্লাবগুলোর অন্যরকম কার্যক্রম বা জৌলুস থাকলেও কালের বিবর্তনে তা এখন অতীত।

ক্লাব থাকলেও এর কার্যক্রমগুলো এখন মলিন; যেন প্রাণহীন। যে ভবনগুলোতে ক্লাবগুলোর অবস্থান, তার অবস্থাও জরাজীর্ণ, কিছু কিছু ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও। এদিকে শুরুতে সামাজিক সেবামুলক ক্লাব প্রতিষ্ঠার রূপরেখা বা উদ্দেশ্য এক রকম হলেও পরে তা পরিবর্তন হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গেছে অনেকাংশেই। সামাজিক সম্প্রীতির পরিবর্তে ঘটছে বিপরীত।  

মোহনীদাস লেনে মুক্তি খেলাঘর আসরে গিয়ে দেখা যায়, অফিস কক্ষ বন্ধ। তবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রচার সম্পাদক মো. আলমগীরের কাছ থেকে জানা যায়, এটি কেন্দ্রীয় খেলাঘরের একটি শাখা। কেন্দ্রীয় খেলাঘর প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৭৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা হয়। তবে মাঝে রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ ১৮ বছর এর কোনো কার্যক্রম ছিল না। এখন আবার চালু হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে এটি থেকে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভেতরে ছোট একটি মাঠ আছে, যেখানে এলাকার স্থানীয় যুবক ও শিশুরা খেলাধুলা করে। তবে পুরনো জৌলুস নেই।

মুক্তি খেলাঘর আসরের একটু পাশেই নাসির বিন কুতুব বিন রহমান মক্তব ও কুতুবখানা। তবে শুরুতে এটি ক্লাব ছিল। ক্লাবের কার্যক্রম হারালে পরবর্তীতে সেটা মক্তব হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মক্তবের দায়িত্বরত হাফেজ বলেন, “পূর্বে এটি ক্লাব ছিল, এখন মক্তব হয়েছে। ৫-৭ বছর পূর্বেই এটিকে মক্তবে রূপান্তর করা হয়েছে।”

কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাব পরিদর্শন করে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় বড় করে ক্লাবের নাম লেখা। এখানে ক্যারাম বোর্ড, দাবা, লুডু খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। একটি পাঠাগারও আছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জলিল আমিন জামাল বলেন, “বেশিভাগ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পরেই ক্লাবটি খোলা থাকে। স্থানীয়রা আড্ডা দেন, খেলাধুলা করেন। তবে এ ক্লাবের সৃষ্টি খেলাধুলা কেন্দ্রীক নয়। সামাজিক সহযোগিতা ও পরস্পরকে কল্যাণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে। শুরুতে ক্লাবটি সামাজিক, সহযোগিতামুলক কার্যক্রম সম্পন্ন করলেও এখন তা নেই। খেলাধুলা, আর রাজনীতিই চলে।”

পুরান ঢাকার অন্যতম ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব। পূর্বে এর অন্যরকম জৌলুস থাকলেও এখন কার্যক্রমে বেশ ভাটা পড়েছে। খেলাধুলা নিয়ে তেমন জাঁকজমকও নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা হাজী এনায়েতুল্লাহ জানান, পাড়া মহল্লার ইউনিটি রাখতে ক্লাবের প্রয়োজন হতো। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে কোন কাজ করা হতো। সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজও সহজেই করা যেত জোট বেধে। কিন্তু এখন আর এসব নেই। কেউ কাউকে চেনে , মেলবন্ধন নেই। ক্লাব এখন মোবাইলে চলে গেছে।”

আদি ঢাকা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মানস বোস বাবুরাম বলেন, “ঢাকায় স্থানীয় মানুষগুলো আগে বেশি ছিল। কিন্তু এখন বহিরাগত বেশি। সেই সঙ্গে মানুষ এখন ফেসবুক ও কম্পিউটার নির্ভর। ফলে ক্লাবগুলোর পরিচর্যা নেই। মানুষ এখন আত্মকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। ফলে ক্লাবের কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটছে এবং আগের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।