বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, তখন তার তীব্র ঢেউ এসে লাগে মো. আরমান হোসেন হৃদয়ের মনে। তিনিও আন্দোলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। জমানো টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ঢাকা এসে সদরঘাটে ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় ওঠেন। এখান থেকেই প্রতিদিন রাজপথের মিছিলে শামিল হতেন তিনি। এরপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের দিন; ৫ আগস্ট। এ দিনই রাজপথে গুলিবিদ্ধ হন হৃদয়। সেই থেকে গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে যন্ত্রণাকাতর দিন পার করে আসছেন তিনি।
হৃদয় পরিবারে পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ। বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার শান্তসীতা গ্রামে। বাবা মো. আয়নাল হক গোয়ালের গরু বিক্রি করে প্রাণপ্রিয় সন্তানের চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে চলেছেন। অভাবের সংসারে তার পক্ষে সন্তানের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার খরচ জোগানো সম্ভব নয়। যে কারণে টাকার অভাবে বর্তমানে হৃদয়ের চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় নন্দনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হৃদয় সদ্য শেষ হওয়া বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও শরীরে তীব্র ব্যথার কারণে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারেননি বলে জানান।
আয়নাল হক বলেন, ‘‘আমরা বুঝিনি সে (হৃদয়) আন্দোলনে যাবে। আমার তিন মেয়ে দুই ছেলে। হৃদয় ছেলেদের মধ্যে ছোট। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সেখানেই হাসপাতালে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু শরীরে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারায় ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাই। তখন ডাক্তাররা জানায় হৃদয়ের মাথায় আরেকটা গুলি রয়ে গেছে।’’
‘‘চিকিৎসা করতে গিয়ে ঘরের গরু ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আমি পাগলের মতো হয়ে আছি। আমার ছেলে ঘুমাতে পারে না। সারারাত ছটফট করে। অথচ ঋণে জর্জরিত হয়ে আছি। বাবা হয়ে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছি না।’’ বলেন আয়নাল হক।
পারিবারিকে সূত্রে জানা যায়, গত ১ আগস্ট বাবা-মাকে না জানিয়ে নিজের জমানো টাকা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় চলে যান হৃদয়। সদরঘাটে ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় থেকে নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট বিকেলে বংশাল থানার সামনে প্রথমে পুলিশের টিয়ারশেলে হৃদয় আহত হন। তারপর ছাত্ররা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে। তার শরীর থেকে দুটি গুলি বের করা হয়। এরপর বাড়িতে চলে আসেন হৃদয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই তীব্র যন্ত্রণা হওয়ায় পুনরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসা চললেও বর্তমানে টাকার অভাবে হৃদয়ের চিকিৎসা বন্ধ আছে।
হৃদয় বলেন, ‘‘সারা দেশে এতো ভাই-বোন আহত-নিহত হচ্ছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। লুকিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ৫ আগস্ট বিকালে আমার শরীরে তিনটা গুলি লাগে। দুইটা বুকে আর একটা মাথায়। বর্তমানে মাথায় গুলি লাগার স্থানে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। কোনো কাজ করতে পারি না। লেখাপড়া হচ্ছে না। রাতে ঘুমাতে পারি না যন্ত্রণায়।’’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোয়াখালী সরকারী কলেজের সমন্বয়ক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘‘হৃদয় সাহস নিয়ে ঢাকায় গিয়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছে। পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তার বাবা গরু বিক্রি করেছেন এটা শুনে কষ্ট লাগছে। হৃদয়ের জন্য কী করা যায় অন্যদের সঙ্গে আলাপ করবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেব।’’
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আঁখিনূর জাহান নীলা বলেন, ‘‘বিষয়টা জানা ছিল না। আরো আগে জানতে পারলে সহযোগিতা করা যেত। তবে এখনো তাকে সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। তার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে তালিকাবদ্ধ হতে হবে। তারপর ভেরিফাই করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’’