বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা করেছেন নিহতদের স্বজনরা। কেউ কেউ এ নিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ও নিয়েছেন। এমনই একটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। দুলাল ওরফে সেলিম নামের এক ব্যক্তিকে আন্দোলনে ‘নিহত’ দেখিয়ে মামলা করেন তার ভাই। সম্প্রতি সেই দুলাল ওরফে সেলিমকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর কাজলায় গোলাগুলিতে ঠিকানা পরিবহনের বাসের হেলপার দুলাল নিহত হয়েছেন, এমন অভিযোগে ২৭ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪১ জনের নামে হত্যা মামলা করা হয়। দুলালের ভাই মোস্তফা কামাল মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, দুলাল নিহত হননি।
বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর দুলাল ওরফে সেলিমকে আদালতে হাজির করে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক মোরশেদ আলম। তবে, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুজ্জামান জবানবন্দি রেকর্ড করেননি। ওই ব্যক্তি দুলাল কি না, সে বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আরও ডকুমেন্ট চেয়েছেন আদালত।
তদন্ত কমকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন,“মামলার তদন্তে গিয়ে দুলালকে উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার তাকে আদালতে হাজির করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করি। এটা একটা বড় মামলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী-এমপিরা আসামি। এজন্য তিনিই যে দুলাল, এর নিশ্চয়তা ও ডকুমেন্ট চেয়েছেন আদালত। তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়নি।”
দুলাল ওরফে সেলিম স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বেলতলী বাজার এলাকায় বাস করছেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, “মাসখানেক আগে ফুলবাড়িয়া থানা থেকে পুলিশ আসে। আমার নাম জিজ্ঞাসা করে। বলি, আমার নাম সেলিম। পরে মামলার বিষয়ে বলে। আমি বলি, কিছু তো জানি না। আমাকে বলে, আপনি তো ৩ আগস্ট গুলিতে মারা যান। আমার ভাইয়েরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমি তো কবরস্থানে আছি। সেখান থেকেই কথা বলছি। পরে পুলিশ আমার কথাবার্তা রেকর্ড করে নিয়ে যায়। এরপর যাত্রাবাড়ী থানায় যাই। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) পুলিশ আমাকে কোর্টে নিয়ে যায়।”
দুলাল ওরফে সেলিম বলেন,“আমরা চার ভাই। আমি সবার ছোট। আমার দুই মেয়ে। ছেলে নাই। তিন ভাই আমার সম্পত্তি তাদের ছেলেদের নামে লিখে দিতে বলে। তা না দেওয়ায় আমার ওপর অত্যাচার শুরু করে। মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাদের ভয়ে বাপের ভিটা ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছি।”
তিনি বলেন,“তিন ভাই মিলে আমাকে মেরে ফেলার মাস্টারপ্ল্যান করেছে। তারা এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা হলো সুবিধাবাদী। যখন যে সরকার আসে, তার কাছ থেকে সুবিধা নেয়। ২০২২ সালে জমি নিয়ে ঝামেলা হয়। তাদের নামে মামলা করেছি। মামলা এখনো চলছে। মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়। না তোলায় অত্যাচার শুরু করে। এর মাঝে ছাত্র আন্দোলন আসে। আমাকে মৃত দেখিয়ে মামলা করল। হয়ত আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে। আমি ঢাকা ছেড়েছি ৮-৯ বছর আগে। আমাকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় গুলিতে নিহত হিসেবে দেখিয়েছে। সম্পদের লোভে হয়ত তারা আমাকে মেরে ফেলবে।”
এ বিষয়ে জানতে দুলালের ভাই মোস্তফা কামালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে, তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাই।
এ বিষয়ে দুলাল ওরফে সেলিম বলেন,“মোস্তফার নামে তিনটি মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। সে কোথায় আছে, কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। পুলিশও তাকে খুঁজছে।”
ঠিকানা পরিবহনের বাসে কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে দুলাল ওরফে সেলিম বলেন,“বেলতলী এলাকায় নিজের একটা দোকান আছে। ভাইদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে সেখানেই স্ত্রীকে নিয়ে থাকি। হেলপারি করব কেমনে?”
মামলায় মোস্তফা কামাল অভিযোগ করেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে গত ৩ আগস্ট কাজলা এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ ১৪ দলের নেতাকর্মীরা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। মাথায় গুলি লেগে মারা যান দুলাল।”
মামলার অপর আসামিদের মধ্যে আছেন—সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, রমেশ চন্দ্র সেন, আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মশিউর রহমান মোল্লা সজল, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি ও সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ডু।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম তার জীবিত স্বামী আল আমিনকে মৃত দেখিয়ে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে তার স্বামী মো. আল আমিন মিয়া (৩৪) নিহত হয়েছেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। ৮ নভেম্বর অভিযোগটি ঢাকার আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত হয়। পরে আল আমিনের জীবিত থাকার তথ্য গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানাধীন এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে।
২১ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় কুলসুম বেগমকে। পরদিন তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।