সারা বাংলা

বাঁশের সাঁকোই ৫ গ্রামের ভরসা

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরলেও হাঁটা-চলার স্বাধীনতা পায়নি পাঁচ গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। দৈনিক কাজে বা যেকোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলেই বাঁধা বাড়ির পাশের ছোট্ট খাল। খালের ওপর নির্মিত নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো দিয়েই পাঁচ গ্রামের মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে বর্ষা এলে বাড়ে দুর্ভোগ। ঝড়-বৃষ্টিতে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সাঁকো পারাপার।

গ্রামের একমাত্র সরকারি কাঁচা রাস্তাটি দেখলে মনে হবে এটি কোনো অজপাড়া গ্রাম। কিন্তু বাস্তবে এটি রাজধানীরই অংশ। বছরের পর বছর একটি পাকা সেতুর অপেক্ষায় ভুক্তভোগীরা। 

বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৫-৭ কিলোমিটারের মধ্যে পুরান ঢাকা ও বুড়িগঙ্গা ঘেঁষা কেরানীগঞ্জের কালিন্দী ইউনিয়নের অবস্থান। ভৌগোলিক দিক দিয়ে শহর ঘেঁষা হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এই ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলে। বিশেষ করে দুই ইউনিয়নের সীমানা ঘেঁষা, দেওশুর, মক্কা নগর, মদীনা নগর, জিয়ানগর, ধুপাশুরসহ কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা বঞ্চিত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ এলাকার জমির দাম বাড়লেও বাড়েনি জীবনযাত্রার মান। গ্রামগুলিতে নেই ভালো কোনো রাস্তা। দেওশুর গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রায় ২০ ফুটের একটি সরকারি রাস্তা থাকলে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এতে চলে না কোনো যানবাহন। এমনকি একটি রিকশাও চলতে দেখা যায়নি এ সড়ক দিয়ে। এছাড়া এ সড়কের মুখে খাগাইল খালের উপর পাকা কোনো ব্রিজ না থাকায় নিজেদের অর্থায়নে নির্মিত বাঁশের সাঁকোই তাদের শেষ ভরসা। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলেও চলাচলের রাস্তা পায়নি গ্রামবাসী। সরকারি রাস্তা না থাকায় অন্যের ব্যক্তিগত রাস্তা দিয়ে চলাচল করে পাঁচ গ্রামের প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। এছাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা খালের উপর স্থায়ী কোনো ব্রিজ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাঙাচুরা বাঁশ ও কাঠের সাঁকো দিয়ে পারাপার হতে হয়। দৈনন্দিন যেকোনো কাজে বের হলেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। সাঁকো পার হতে গিয়ে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু, বৃদ্ধা আর রুগীরা পড়ছেন বেশি বিপাকে। সাঁকোর বাঁশ বা কাঠ ভেঙে মাঝে-মধ্যেই আহত হন অনেকে। পানিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। 

স্থানীয় যুবক শান্ত বলেন, “নির্বাচন এলেই জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন আশ্বাস দেন, কিন্তু কোনো আশ্বাসই আলোর মুখ দেখেনি গত ৫০ বছরে। সর্বশেষ জিয়ানগর-দেওশুর দিয়ে একটি পাকা ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি।” 

স্থানীয় বাসিন্দা মো. তাজু বলেন, “২০ বছর ধরে এখানে (ব্রিজের পাশে) বসবাস করি। এটি একটি পায়ে হাঁটার রাস্তা, কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে এই রাস্তা ও বাঁশ-কাঠের সাঁকো দিয়ে। বিগত দিনে অনেক নেতা আশ্বাস দিলেও ব্রিজ করে দেয়নি কেউ। মাঝে-মধ্যেই সাঁকো থেকে পড়ে অনেকে আহত হয়। ব্রিজটি করে দিলে সকলের উপকার হতো।”

 

দেওশুর গ্রামের বাসেরুন বেগম (৭০) বলেন, “পঞ্চাশ বছর ধরে দেখছি রাস্তার এ অবস্থা। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু রাস্তার উন্নতি হয় না। কেউ অসুস্থ হলে রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থাও নেই এই গ্রামের মানুষের। কিছু চাওয়ার নেই, কারণ চাইতে চাইতে আমরা ক্লান্ত। বাকি জীবন কোনো মতে কাটিয়ে যেতে চাই।” 

গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ বলেন, “এলাকাটিতে বড় মাপের কোনো লোক না থাকায় ও বহিরাগত লোকজন বেশি হওয়া এবং রাস্তার পাশে বড় বড় আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠায় ভেতরের গ্রামগুলোতে কারো নজর পড়ে না। ব্যক্তিগত রাস্তাটি বন্ধ করে দিলে আমাদের চলাচলের কোনো পথ থাকবে না।” 

এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান বলেন, “যেহেতু আমি নতুন এসেছি, বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে শুনলাম। দেওসুর এলাকাটি দ্রুত পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করবো।”