আন্তর্জাতিক

কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার নিয়ে বিজিবির দাবি নাকচ বিএসএফের

কোদলা নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের বিষয়টি সামনে এসেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ অর্থাৎ বিজিবি দাবি করেছে, কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার অংশ ভারতের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা হয়েছে। মূলত এই দাবির পরই কোদলা নদী নিয়ে সবার আগ্রহ বেড়েছে।  তবে, এর মধ্যেই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বিজিবির দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা বলেছে, ‘‘কোলদা নদী ভারতের ছিল, ভারতেরই আছে।’’

কোদলা নদী বাংলাদেশ অংশে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার মাটিলা সীমান্ত দিয়ে বয়ে গেছে। আর ভারতের অংশে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলার মধ্যবর্তী বাগদা ব্লকের রনঘাট গ্রাম ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

মহেশপুর-৫৮ বিজিবি ৬ জানুয়ারি এই কোদলা নদীর পাড়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নদীটি ভারতের দখল থেকে মুক্ত করার তথ্য জানায়। ৫৮ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুস শহীদ জানান, এতদিন নদীতে বাংলাদেশিরা মাছ ধরতে বা গোসলের জন্যও নামতে পারত না; এখন সেটা পারবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৫৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিক, মাটিলা ক্যাম্প কমান্ডার মোক্তার হোসেন।

অধিনায়ক আজিজুস শহীদ জানান, মাটিলা সীমান্তে কোলঘেঁষে কোদলা নদী বহমান। এ নদীর ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে পড়েছে। এতদিন ধরে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ লোকজনকে নদীতে মাছ ধরা বা প্রয়োজনীয় কাজ করতে বাধা দিতো। সম্প্রতি সেটি উভয়পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে বিজিবি দখল প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিজিবির দাবি ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করেছে বিএসএফ। তবে, ভারতীয়দের এই বক্তব্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য? তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবে ঠিক কী পরিস্থিতি রয়েছে সীমান্তের এই অংশে? 

বুধবার সরেজমিন সাম্প্রতিক সময়ের এই বিবাদপূর্ণ এলাকায় দেখা যায়, পরিস্থিতি ‘মোটের-ওপর’ স্বাভাবিক। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এলাকাজুড়েই রয়েছে চাপা উত্তেজনা। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সীমান্ত ও নদী বরাবর এলাকা নিজেদের দাবি করে নিয়মিত মাইকিং করছে। বিজিবির দাবি, রনঘাট এলাকায় শুধু কোদালিয়া নদী নয়, নদীর পরেও অন্তত ৪০০ মিটার এলাকা বাংলাদেশের ভূখণ্ড। তাই এই এলাকা ছেড়ে ভারতীয় নাগরিকদের সরে যাওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন তারা। একইসঙ্গে নদী ও নদীসংলগ্ন একাধিক পুকুর যেহেতু বাংলাদেশের, তাই ভারতীয় নাগরিকদের নদীতে, পুকুরে গোসল করা কিংবা মাছ ধরার ক্ষেত্রেও নিষেধ করে মাইকিং করছে বিজিবি। 

স্থানীয় গ্রামবাসী বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘সীমান্তের রনঘাট এলাকার এই অংশটিতে কাঁটাতার নেই।’’ সীমান্তের ওপারেই নদী বলেও স্বীকার করেন এই গ্রামবাসী। তার দাবি, বিগত ৫০ বছর ধরে এই এলাকায় কোদালিয়া নদী তারা ব্যবহার করে আসছেন। তাদের ধারণা, সীমান্ত নদীর মাধ্যমেই বিভক্ত। তিনি জানান, নদীর পাড়ে যে সীমানা পিলার ছিল, সেটি সম্প্রতি বিজিবি তুলে নিয়েছে।

ভারতীয় কৃষক সৌমিত্র সাতরা বলেন, ‘‘ভারতের যে অংশ বিজিবি বাংলাদেশের ভূখণ্ড বলে দাবি করছে, সেখানে অন্তত ৭০০-৮০০ বসতবাড়ি রয়েছে। সীমান্তের এই অংশে ও জিরো পয়েন্ট এলাকায় বহু ভারতের চাষবাসের জমি রয়েছে। বিজিবির এমন ঘোষণা রীতিমত এই এলাকার মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক-উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। তবে, মাইকিংয়ের মধ্যেই বিজিবির ভূখণ্ড দাবির বিষয়টা সীমাবদ্ধ। তাই নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়নি। সীমান্তে বিএসএফের পাহারায় অন্যান্য সময়ের মতই স্বাভাবিক গতিবিধি রয়েছে ভারতীয়দের।’’ 

এদিকে, বিজিবি আর বিএসএফের দাবির স্বপক্ষে নদী বা নদীসংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় যেমন দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কারোরই ব্যাপক উপস্থিতি মেলেনি; তেমনই মোটরচালিত নৌকা ও এটিভি ব্যবহার করে ওই এলাকায় ২৪ ঘণ্টা টহল চালানোর মত কোনো ছবিও সামনে আসেনি।

সম্প্রতি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ভারতের দখলে থাকা কোদালিয়া নদী বরাবর ৫ কিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করে বিজিবি। স্বাধীনতার পর থেকেই কোদলা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ওই অংশ ভারতের বিএসএফ দখল করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ৫৮ বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

ঝিনাইদহের মহেশপুরে কোদলা নদী ভারতীয় দখলমুক্ত করার পর বিজিবি কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। গত সোমবার উপজেলার মাটিলা গ্রামে

বিজিবির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, কোদালিয়া নদী বাংলাদেশের অভ্যন্তর হতে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হয়ে মহেশপুরের মাটিলা এলাকায় ৪.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চিহ্নিত করেছে। ১৯৬১ সালে প্রণীত বাংলাদেশ-ভারত (স্টিপ ম্যাপ সিট নম্বর-৫১) মানচিত্র অনুসারে কোদলা নদীর উল্লিখিত ৪.৮ কিলোমিটার নদী সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্য রেখার অভ্যন্তরে অবস্থিত।

বিজ্ঞপ্তি থেকে আরো জানা যায়, সম্প্রতি কোদালিয়া নদীর প্রকৃত মালিকানা-সংক্রান্ত এই বিষয়টি ৫৮ বিজিবির নজরে আসে। এরপর বিজিবি প্রথমে বিভিন্ন নথিপত্র স্থানীয় প্রশাসন ও মানচিত্র থেকে নদীটির প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে বিএসএফের অবৈধ আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পরে ৫৮ বিজিবির সদস্যরা সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কোদালিয়া নদী নিজেদের আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বিজিবি সদস্যরা প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকার জন্য যন্ত্রচালিত বোট এবং নদীর পাড়ে দ্রুত টহলের জন্য অল টেরেইন ভেহিকেল (এটিভি) বরাদ্দ করা হয়েছে।

পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করে বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার বলেছে, বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের একটি অংশে প্রকাশিত এই ধরনের প্রতিবেদনে ‘সত্য ও যোগ্যতার’ অভাব রয়েছে। বিজিবি আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ভারতের অন্তর্গত ৫ কিলোমিটার জমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এমন প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মঙ্গলবার প্রত্যাখ্যান করে বিএসএফ।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ফাইল ছবি

ভারতের এই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দাবি, ভারতীয় ভূখণ্ডের এক ইঞ্চিও প্রতিপক্ষের দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়নি বা হবেও না। বিএসএফ এবং বিজিবি উভয়ই ‘ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্দেশিকা, ১৯৭৫’ অনুসারে তাদের নিজ নিজ এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে; যাতে সীমান্তের অখণ্ডতা নিশ্চিত করা যায়। আন্তর্জাতিক সীমানা ও বিএসএফের ডিউটি প্যাটার্ন কয়েক দশক ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো ‘মনগড়া গল্প’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিএসএফ ও বিজিবি নদীর নিজ নিজ তীরে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে, যা আন্তর্জাতিক সীমানা (আইবি) হিসেবে কাজ করে। এই ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট দাবি শুধুমাত্র দুই সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সদ্ভাবকে নষ্ট করবে।