শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে জারি করা সরকারি অধ্যাদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং এই মুহূর্তেই টিসিবির ট্রাক-সেল চালু করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
শনিবার (১১ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে নিজেদের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটি এসব দাবি জানিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে কমিটির অবস্থান তুলে ধরেন সংগঠনটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আখতার হোসেন বলেন, “সম্প্রতি সরকার রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য দুটো অধ্যাদেশ জারি করেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসার খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার তার রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য করের আওতা বাড়াবে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় ও তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে, সে বিষয়টি সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “বিগত অবৈধ সরকারের গণবিরোধী লুটেরা অর্থনৈতিক নীতি ও বিদেশে সীমাহীন অর্থপাচারের ফলে সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্তের জীবন ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। মহামারি করোনায় নিঃস্ব হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিল অনেক পরিবার, যারা আর শহরে ফিরতে পারেনি। সরকারি মেগা প্রজেক্টে বিদেশ থেকে কর্মী এনে কাজ করানো হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বেকার শ্রমিক বসতভিটা, কৃষিজমি ও হালের গরু বিক্রি করে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছে। কারণ, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সেক্টরে তৈরি হয়েছিল সিন্ডিকেট। গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে নারীশ্রমিক বারবার বঞ্চিত হয়েছে ন্যায্য মজুরি থেকে, বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে। আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তার কষ্টের কথা বলতে না পেরে হয় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, না হয় দেশেই মানবেতর জীবন বেছে নিতে হচ্ছে।”
“২০২৪ সালে এই মধ্যবিত্ত, এই গার্মেন্টস শ্রমিক, এই সাধারণ মানুষ অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পতনের পর ন্যূনতম জীবনযাপনের উপকরণগুলো তাদের জন্য সহজলভ্য হবে, ভেঙে যাবে লুটেরার সিন্ডিকেট, বৃদ্ধি পাবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা, ফিরে পাবে তাদের আত্মমর্যাদা।”
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব বলেন, “বিগত অবৈধ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচারের কারণে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। এ অবস্থায় বিগত অবৈধ সরকার আইএমএফের কাছ থেকে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আপনারা জানেন যেকোনো দেশের জন্য আইএমএফের ঋণ হলো ঋণপ্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়। এই কঠিন ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি এ অধ্যাদেশগুলো জারি করেছে।”
“কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন-বর্তমান সরকার ঋণের এই শর্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছে কি? তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার একটি অবৈধ সরকারের চুক্তির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জনদুর্ভোগ বাড়াতে পারে না।”
আখতার বলেন, “পাশাপাশি আপনারা অবগত আছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) গরিব জনগণ যাতে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে তার জন্য ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রি করে। এটি একটি অবমাননাকর প্রক্রিয়া। আমরা দেখেছি এই দেশের নাগরিক কীভাবে ট্রাকের পেছনে পাঁচ টাকা ১০ টাকা কমে চাল, ডাল ও তেল কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ধরনের প্রান্তিক মানুষদের রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যূনতম যে অধিকার, তাও ট্রাক-সেল বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা কল্পনা করতে পারি না জনগণের প্রতি কতটা দায়হীন অনুভব করলে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
“এমতাবস্থায়, আমরা সরকারের কাছে স্পষ্টভাবে দাবি জানাই-অবিলম্বে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি সংক্রান্ত অধ্যাদেশগুলো প্রত্যাহার করতে হবে ও টিসিবির ট্রাক সেল এই মুহূর্তে চালু করতে হবে।”
বিকল্প প্রস্তাব দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেগুলো হলো- ১। প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে ও কর জাল সম্প্রসারণ করতে হবে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না। আমরা জানি প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অবশ্যই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।
২। বিদ্যমান কর কাঠামোয় যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয় বাড়বে।
৩। বিগত সরকার ১৫ বছরে বিদেশে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে বলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সেগুলো দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪। গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে ও খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এগুলো আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে।
৫। দেশে বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত (২০০৩) সরকারকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করার যাবতীয় আইনি সুযোগ দিয়েছে। সরকার এ সুযোগ ব্যবহার করে দ্রুত একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খেলাপি অর্থ আদায় ও অনাদায়ে তাদের সম্পত্তি ক্রোক করতে পারে।