কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক ফজলুল কবিরীর জন্ম ১৯৮১ সালে। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানাধীন হালদা নদী-তীরবর্তী গ্রাম উত্তর মাদার্শায়। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ফজলুল কবিরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বারুদের মুখোশ’, ‘ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া গল্প’, ‘ডোরাকাটা ক্যাডবেরি’। ‘ঔরসমঙ্গল’ তার পাঠকপ্রিয় উপন্যাস। ফজলুল কবিরী তার গল্পভাবনা, ভাষাভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি
রাইজিংবিডি: আপনার একটি গল্প থেকে আরেকটি গল্পের ভাষা ও আঙ্গিক আলাদা। যখন গল্প নির্মাণ শুরু করেন গল্পের বিষয়বস্তু ভাষাকে নির্মাণ করে না কি ভাষা গল্পের বিষয়বস্তু ধারণ করে নেয়?
ফজলুল কবিরী: লেখালেখি শেষপর্যন্ত স্কিল ও মরালিটির লড়াই। সেইসাথে খুবই ঊর্বর মস্তিষ্ক ও সহজাত প্রতিভার পাশাপাশি যেসব লেখক তীব্র পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে জন্মান, তারাই লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবে সাহিত্যের বিশাল দিগন্তে রাজত্ব করেন। তারাই সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন চিন্তার রাস্তা নির্মাণ করেন। এর মানে এই নয় যে, বাকিরা দুধভাত। সমাজ-রাষ্ট্রের অসুখ সারাতে নিত্য যেসব দায় লেখকদের থাকে, ছোট-বড় সব লেখক-চিন্তক মিলেই সেসব দায় সামলান। তাদের মধ্যে দলীয় দাসত্বের ঊর্ধ্বে উঠে যারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করেন, তারাই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। সে প্রাসঙ্গিকতার জায়গা থেকে গল্পের শরীরে জীবন পায় ভাষা ও চিন্তার নতুন প্রবাহ। মূলত বিষয়ই নির্ধারণ করে দেয় গল্পের ভাষা কেমন হবে। ফলে আদিবাসীদের নিপীড়িত হওয়ার গল্প যে ভাষায় উঠে আসে, ঠিক একই ভাষায় রচিত হয় না অন্য কোনো সংখ্যালঘু মানুষের সংগ্রামের গল্প। কর্পোরেট হিপোক্রেসির গল্প যে ভাষায় উঠে আসে, ঠিক একই ভাষায় ধরা দেয় না অন্য কোনো গভীর পরিসরের গল্প।
রাইজিংবিডি: চলমান রাজনৈতিক বৃত্তে দাঁড়িয়ে এর বাইরে পাঠককে ভাবাবার যে ভাষা বিনির্মাণ করতে হয়, সেই ভাষা বিনির্মাণে একজন গল্পকার কতটুকু স্বাধীন বা পরাধীন?
ফজলুল কবিরী: একটা আশঙ্কার কথা প্রায়শ বলি- তা হচ্ছে, ভাষা ও চিন্তার পরাধীনতা। এমনকি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যতের সাহিত্য কর্পোরেট সাহিত্যেরই ইতিহাস হবে। এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই একজন লেখককে এগোতে হবে। আমরা গরিবি সাহিত্যচর্চার ভেতর দিয়ে যে রোদন, দ্রোহ ও প্রগতির বার্তা সমাজ ও রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিতে চাই, তাকে আরও বেশি প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আমরা লেখকরা হয়তো উড়েই যাব। ফলে বই প্রকাশের সাময়িক সুখ ও উত্তেজনার বাইরে যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পাঠযোগ্য ও গভীর পরিসর নিয়ে আগানো একটি বইয়ের বাজার তৈরিতে অধিক মনোযোগী হওয়া; আরও জরুরি হচ্ছে নিষ্ঠাবান পাঠক তৈরি করা। সেসব হচ্ছে না। এদেশের লেখক-পাঠকদের করুণ দশা দেখে বিচলিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রকাশের প্রাথমিক পর্বেই গলাটিপে হত্যা করা হয় একেকটি বইয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে। লেখক হিসেবে আমরা খুব সামান্যই স্বাধীন।
রাইজিংবিডি: গল্পে আলাদা চিন্তা থাকে। প্রশ্নকে উত্তর আর উত্তরকে প্রশ্নে রূপান্তর করা যায়। এই যে প্রক্রিয়া এর সামাজিক প্রয়োজনিয়তা কতটুকু আছে বলে মনে করেন?
ফজলুল কবিরী: একটা চিন্তার জীবনকাল থাকে। চিন্তারও মৃত্যু ঘটে একসময়। অন্য কোনো নতুন চিন্তা বিকশিত হয়। ফলে লেখকদের কাজ হচ্ছে চিন্তার প্রবাহ সচল রাখা। সমাজে অসংখ্য তরুণ এখনো লেখক হতে চান। এমনকি জীবিকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যতের ঝুঁকিপূর্ণ একটা জার্নিকে ভালোবাসতে চান। এসবের প্রয়োজন আছে। তবে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করে? দশকের পর দশক তারা চিন্তা ও দর্শনের অলিগলিতে নিজেদের বিলিয়ে দেন, কিন্তু এই বিকাশের পথে তারা এমন কিছু অপ্রত্যাশিত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন যা তাদের মগ্নপাঠ ও জ্ঞানচর্চার পথে অন্তরায়। লেখকের নিবিড় দর্শনের কাছে নয়, পাঠক ছুটছেন স্পোকেন ইংলিশ কিংবা রগরগে মিথ্যাচারের পেছনে। তবু এসব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গল্পেও নবতর চিন্তার বীজ বোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাইজিংবিডি: ২০২৫ বইমেলায় আপনার নতুন-পুরোনো কী বই থাকছে?
ফজলুল কবিরী: ২০২৫-এর বইমেলায় আমার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ 'গান্ধর্ব গল্পগুচ্ছ' প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে দ্বিমত পাবলিশার্স। ঢাকা বইমেলায় বইটির পরিবেশক ‘জলধি’। জলধি থেকে ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল আমার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ডোরাকাটা ক্যাডবেরি’। সেটিও পাওয়া যাচ্ছে একই স্টলে। এছাড়া আমার প্রবন্ধের বই ‘লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে’ ২০২৩ সালে প্রকাশ করেছিল দ্বিমত পাবলিশার্স। বইটিও প্রকাশক দ্বিমত এবং রকমারিতে পাওয়া যাচ্ছে। আমার একমাত্র উপন্যাস ‘ঔরসমঙ্গল’ পাওয়া যাচ্ছে প্রকাশক বেহুলাবাংলার স্টলে।
রাইজিংবিডি: আপনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা মতাদর্শ আমাদের কাছে সার্কাস হয়ে এসেছে’—একটু ব্যাখ্যা করবেন।
ফজলুল কবিরী: রাষ্ট্রের যে আলাদা ও স্বাধীন অস্তিত্ব আমরা কল্পনা করি সেটি সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মত ও পথকে জায়গা দিতে বাধ্য। মানুষ নির্ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করবে। এটি হচ্ছে বেঞ্চমার্ক। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশকে শাসকগোষ্ঠী মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। আমাদের শাসনব্যবস্থায় সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ কোন শাসকই উন্মুক্ত রাখেননি। ফলে তাদের মিথ্যাচারকে সার্কাস হিসেবেই দেখা উচিত।
রাইজিংবিডি: আপনি লেখা ও পড়ার মধ্যে সমন্বয় করেন কীভাবে? কখন বেশি লেখা হয়?
ফজলুল কবিরী: লেখককে চব্বিশ ঘণ্টাই চিন্তা এবং লেখালেখির ভাবনাপ্রবাহের মধ্যে থাকতে হয়। একজন লেখককে বুঝতে হয় লেখালেখিতে নিজের ভালো কিংবা খারাপ সময়ে খুব কম সতীর্থকেই কাছে পাওয়া যায়। এমনকি একসময় যাদের সঙ্গে অনেকগুলো বসন্ত কাটানোর অভিজ্ঞতা ছিল, যাদের সাথে তর্কে-বিতর্কে কেটে যেত অসংখ্য সন্ধ্যা, তাদেরকেও লেখালেখির অন্য পর্বে আর কাছে পাওয়া যায় না। নিজের উচ্চতাকে অন্যের ছায়ায় মাপতে নেই। নিজেকে নিজের পথ খোঁজে নিতে হয়। যাদের সংশ্লেষ একজন লেখকের চিন্তা ও তৎপরতায় কোনো কিছু যোগ করবে না, তাদের সঙ্গ বয়ে বেড়ানো অর্থহীন। এভাবেই একজন লেখককে লেখা ও পড়ার মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। ছুটির দিনগুলোতে লেখার পরিমান বেশি হয় আর পাঠের জন্য ছুটির দিন বলে কিছু নেই। লেখক একটা ছুটন্ত ট্রেনের যাত্রী। লেখককে ছুটতে হয় নতুন চিন্তার খোঁজে। ভাষার ঝর্ণাধারার খোঁজে।