ভাষাকে আমরা কীভাবে দেখি? তথ্যপ্রযুক্তির উত্তাল এই সময়ে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার কি এখনো কোনো আলাদা গুরুত্ব থাকা সম্ভব? বিশ্বায়নের একার্ণবের কালে স্বতন্ত্র ভাষার প্রয়োজনিয়তা কি ফুরিয়ে আসছে? এগুলো গভীর আলোচনার বিষয়, তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উত্তরাধুনিক অধিকাংশ তাত্ত্বিকই কোনো না কোনোভাবে ভাষাতাত্ত্বিক। কেননা তারা জানেন এই তীব্র গতির অস্থির সময়ে ভাষাই মানুষকে দিতে পারে নিজস্ব সত্তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা। ভাষার খনন বুনন থেকেই পাওয়া যায় জ্ঞানের অদেখা ভুবনের সন্ধান। ভাষার এমন বহুবিদ বিষয়ে অজস্র আলোচনা সমালোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং হতে থাকবে। হাজারো বিশেষজ্ঞ মতামত তথ্য-উপাত্তে পরিপূর্ণ আলোচনাগুলোর সামনে একটি সাধারণ প্রশ্ন রাখতে চাই, ভাষা বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য কি আত্মপরিচয়? যোগাযোগ? রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি? না বিশেষ দিবসে, বিশেষ মাসে বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিকতা আনয়ন?
অপেক্ষাকৃত কম জটিল উত্তরটি বোধ হয় যোগাযোগ। তাছাড়া ভাষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একটি জনগোষ্ঠীর পরিচিতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই ভাষার বিকল্প নেই। তবে ভাষা যেমন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, তেমনি ভেঙ্গেও দিতে পারে এবং নস্যাৎ করে দিতে পারে পরিচিতিকেও। তাই আমরা নিজস্ব পরিচিতি কিংবা পারস্পরিক সেতুবন্ধনের দিকে যাচ্ছি না কি বিচ্ছিন্নতার দিকে অগ্রসর হয়ে নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছি তার একটি হদিস নিতে ভাষা উৎপত্তির ইতিহাসে আমাদের আবার দৃষ্টি দেয়া দরকার। আমাদের জানা থাকা দরকার আত্মপরিচয় এবং যথার্থ যোগাযোগের পদ্ধতিকে আমরা কোন অবস্থায় রেখেছি?
মানুষ তার ভাব প্রকাশ এবং প্রকাশকে দূরবর্তী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার আকাঙ্খায় ভাষা এবং বর্ণমালার উদ্ভব ঘটায়। ভাষা, লিখন পদ্ধতি এবং প্রকাশভঙ্গি তার পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলে। পৃথিবীর প্রায় হাজার তিনেক প্রধান অপ্রধান ভাষায় মানুষ তাদের মনোভাব প্রকাশ করছে। এর মাঝে ২৫-২৬টি ভাষা পরিবারে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কথা বলে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে, স্থানিক পরিবেশের ভিন্নতায় ভাষার প্রকাশভঙ্গি সুর স্বর ও আঙ্গিকে আলাদা হয়ে গেছে। এই আলাদা বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান থাকা বা স্বতন্ত্র অবস্থানে টিকে থাকাই তার আত্মপরিচিতির অংশ।
বাংলা ভাষা সম্পর্কিত ইতিহাস এবং গবেষণা গ্রন্থগুলো আমাদের ভাষার গতিবিধি, বিবর্তন, বৈচিত্র্য ও বিবিধ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা দেয়। এ সকল ইতিহাস এবং গবেষণা গ্রন্থগুলোর প্রামাণিকতা বলতে তাদের নানাবিধ তথ্যসূত্রের উল্লেখপঞ্জি, এর অধিকাংশই আবার পূর্ববর্তী কোনো তথ্যের অনুবর্তী। মূল কাঠামোই নির্মিত হচ্ছে অপরের উল্লেখিত সূত্রের উপর ভর করে, এদের প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো পূর্বোক্ত উপাত্তের উপর অতি নির্ভরতা। এই নির্ভরতাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এসব তাত্ত্বিক কাঠামো পূর্ব পরিকল্পিত প্রকল্পের অংশ (যদিও এটিই স্বাভাবিক যে, একজন গবেষকের একটি পরিকল্পনা থাকবে, এবং এ কারণেই তথ্যটি নেয়ার আগে তার প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে), প্রকল্পগুলো প্রমাণিত সত্য হিসেবে প্রতীয়মান করার জন্য এর স্বপক্ষে যুক্তি সিঁড়ি ব্যবহার করে তাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে (কথিত আলোকায়নের যুগ থেকেই এই বিধি চলমান যে, যুক্তি শৃংখলার ভিতর দিয়ে কোনো একটা কিছুকে প্রমাণ করা কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা যুক্তিফাটলের বিষয়গুলো খুব সহজেই সামনে পেয়ে যাচ্ছি, যুক্তির নৈরাজ্য, যুক্তির হেজিমনি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কেও আমরা জানি; কাজেই একমাত্র যুক্তিরই বৈধতা আছে এমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না)।
তথ্যপঞ্জির উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের বাস্তবতা থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিচ্ছে; প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ লব্ধ বাস্তবজ্ঞানের ভূমিকা গৌণ থেকে গৌণতর হচ্ছে। আরেকটি লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলা অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণেই হোক অথবা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার কারণেই হোক এখানে পশ্চিমা পদ্ধতিতে ডকুমেন্টেশনের কোনো প্রাচীন ধারা চলমান নেই, (অপ্রয়োজনীয় সংরক্ষণের লোভকে থেকে স্থানীয় দর্শন-সংস্কৃতি সবসময়ই নিরুৎসাহিত করেছে) সুতরাং আমাদের এমন উৎস থেকে তথ্য জোগাড় করতে হয় যারা মোটেই আমাদের শুভাকাঙ্খি নয় বরং স্বেচ্ছাচারী দাম্ভিক শাসক শোষক তাত্ত্বিকদের থেকে আমরা যেসব প্রমাণ হাজির করি তার অধিকাংশই আত্মঘাতি। তাদের তথ্য স্মারণী বিন্যস্ত করে আমরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হই বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিবৃত্ত। ইতিহাস বিশ্লেষক ই এইচ কার বলছেন, ‘ইতিহাসের তথ্য কখনোই আমাদের কাছে বিশুদ্ধ রূপে আসে না। [...] আমরা যখন কোনো ইতিহাসের বই বেছে নিই তখন তার ভেতরকার তথ্যই আমাদের প্রথম বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়, যে-ঐতিহাসিক সেটি লিখেছিলেন তিনিই আমাদের বিবেচ্য। [...] তথ্য অনুধাবন শুরু করার আগে ঐতিহাসিককে অনুধাবন করুন।’
কিন্তু ইতিহাসকে আমরা কোনো অজ্ঞাত কারণে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণ করতে শিখেছি। যেহেতু পুঁথিগত বিদ্যায় আমাদের ভরসা আছে, সেহেতু বিনা প্রশ্নে আমরা সেসব স্মারণী থেকে পুণঃপুণঃ উদ্ধৃত করতেই থাকি। আদি পাপের মতোই জেনেছি আমরা বাঙালি এবং আমাদের উচ্চারিত বাংলা ভাষা মূলত পাপি, তাদের সঠিক পিতৃ পরিচয় নেই, (সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রমাণপত্র জোগাড় করার দায় আমাদের ছিল না, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মম্ভরিতা বাংলার জল-ভুগোলের সাথে মানানসই নয়, পেটেন্ট-কপিরাইট-সার্টিফিকেট সর্বস্ব বিদ্যার ধারণা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আমাদের সুপ্রাচীন সর্বজন বিদিত মসলিনকেও জি আই প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়, ইলিশেরও জি আই পাওয়া হয়ে গেছে, এমনি করে বাংলার পুকুর-নদী-জল-বায়ু-ভাষা প্রত্যায়িত সনদ ছাড়া আমাদের নয়। কথিত আছে বিজ্ঞানি জগদীশ বসু রেডিও আবিষ্কারের স্বত্ত্ব নিজের নামে লিখিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, মার্কনি ঠিকই নিজের নাম আবিষ্কর্তার স্থানে বসিয়েছেন; এখানেই জীবনদর্শনের পার্থক্য; এই পার্থক্যটুকু না বুঝলে বাংলা ভাষার ইতিহাস বোঝা যাবে না।)
সঠিক ঠিকুজি নির্ণয়ের জন্য যত প্রমাণপত্র জোগাড় করতে হয় তার কিছুই আমরা রাখিনি, রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি কিন্তু এখন বড় দায়ে পড়ে যাওয়া অবস্থায় আমরা হন্যে হয়ে পরিচিতি খুঁজে আধা খেচরা একটা কিছু দাঁড় করিয়ে ইজ্জত রক্ষার তাগিদে পেরেশান হয়ে আছি। সুতরাং তথ্যপঞ্জি সংগ্রহ করো এবং প্রমাণ করো বাংলা কোন ভাষা থেকে এসেছে (তাকে কারো না কারো উদর থেকে বের হতেই হবে)। পুঁথিগত বিদ্যার এই হলো পরিণাম। বাংলার ভৌগোলিক বিন্যাস কখনো আমাদের চোখে পড়ে না, এখানে একটি স্বয়ম্ভু ভাষা থাকতে পারে, এই ভুগোল একটি ভাষার জন্মভূমি হতে পারে এমন ধারণার সম্ভাবনাও আমরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নই। পুঁথি আমাদের কেন্দ্র চিনিয়েছে, প্রান্ত সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। প্রান্তে কিছুই তৈরি হয় না এটিও শিখিয়েছে। আমরা একটি অতি সাধারণ প্রশ্ন করতে চাই- বাংলা কি এই অঞ্চলে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম নিতে পারে? যার কিছু অংশকে আমরা মাঝে মাঝে দেশি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করি?
আমাদের নমস্য বিদ্ব্যান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন, ‘নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানিতে গেলে আমাদিগকে বলিতে হইবে যে জাতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও এক মূলভাষা বহু যুগের বহু স্থানের বহু লোকের মুখে মুখে ধারাবাহিক পরিবর্তনের ফলে আমাদের বর্তমান বাঙ্গালায় আসিয়াছে।’ তাহলে এই বাংলা ভাষা এখানে আসিয়াছে; কেন? এই ভাষা আসার আগে এই অঞ্চলের মানুষ কি নির্বাক ছিলো? নাকি মানুষই ছিল না? আমরা জানি অভিপ্রয়ণের পুরানো ইতিহাস সাম্প্রতিক সময়ের আর্কিওজেনেটিক্সের তথ্য-উপাত্ত সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। তিনি বলেছেন ‘নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানিতে গেলে’, নৃতত্ত্ববিদ কারা? এর উৎপত্তি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের কি কিছুই জানা নেই? কোন কোন জাতিকে নৃতত্ত্ববিদগণ শ্রেষ্ঠ এবং কোন কোন জাতিকে নিকৃষ্ট বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করেন? কেন করেন? সবই নির্দোষ গবেষণা? রিজলি, রমাপ্রসাদ চন্দ, বিরজা শংকর গুহসহ অনেকেই বাঙালিকে বিচার করেছেন- মাথা, কপাল, নাক, ঠোঁট কিংবা চোখ, চুল, চামড়া পরীক্ষার মাধ্যমে; একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে এই পরীক্ষাগুলো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নামে কতটা হাস্যকরভাবে শিশুসুলভ।
সাম্প্রতিক জেনেটিক গবেষণা এগুলোকে ইতোমধ্যেই আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। বাংলার আরেকজন নমস্য পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ বাঙালির রক্তধারায় মিশ্রণ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন- ‘শতকরা ষাট ভাগ অস্ট্রেলীয়, বিশ ভাগ মঙ্গোলীয়, পনের ভাগ নেগ্রিটো এবং পাঁচ ভাগ অন্য নানা নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়।’ এভাবে শতভাগ দূষিত রক্তের সংকর জাতির ভাষাও সংকর এবং বিদেশাগত হবে এই চিন্তাইতো স্বাভাবিক। পুঁথিগত বিদ্যা এবং তার উপর অতি নির্ভরতার ফল হলো এই যে, আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ব্যক্তিরাও স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। মনের অজান্তেই জাতির উপর ভাষার উপর চাপিয়ে দেন অমোচনীয় কালির ঘোর অন্ধকার। যদি আমরা ভাবতে পারতাম বাঙালি জাতির উৎপত্তি এই বাংলা ভুগোলেই, তাহলে সহজেই ভাবা যেতো তাদের একটি ভাষা ছিল যার বর্তমান নাম বাংলা ভাষা। যখন আমরা সাবেকি আমলের স্বার্থবাদী পুঁথি-পত্রের ভাষ্যের সাথে মিলিয়ে নিজেদের বহিরাগত হিসেবে প্রমাণ করছি তখন ভাষার বহিরাগত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা থাকে না; কাজেই ভাষার প্রশ্ন প্রথমেই জাতির প্রশ্ন। সারা পৃথিবীর সকল জাতিই সংকর, সকল ভাষাই সংকর ভাষা। তাহলে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির প্রতি এই বিদ্বেষ কেন? এমন অপমানজনক আর্কিটাইপের বিষয়ে অবশ্যই গভীর মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া জরুরি।
মহাজাতি কিংবা মহাভাষার কাল্পনিক প্রকল্পগুলো নানাবিধ বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা ও পরীক্ষার নামে অনেকটাই অকাট্য করে তোলা হয়েছে, পরিস্থিতি এমন যে, কেউ এখন প্রশ্নগুলো উত্থাপনেই দ্বিধান্বিত থাকেন কারণ তার হাতে পাশ্চাত্য পন্থায় কোনো প্রমাণ নেই, তাছাড়া প্রমাণ উপস্থাপনও কঠিন শ্রমসাপেক্ষ বিষয়। তবে বাস্তব অবস্থা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টা সাক্ষ্য দিচ্ছে, বলছে ভিন্ন কোন সমীকরণের কথা, কারণ আমাদের হাতে আছে ভৌগোলিক ও প্রকৃতি সমর্থিত যৌক্তিক বাস্তবতা। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল ঊর্বর ভূমির অঞ্চল হলো এই বাংলা। প্রাচীন কাল থেকেই বসবাসের জন্য যথাযথ উপকরণে সমৃদ্ধ এই ঊর্বর ভূমিতে মানুষকে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজনে আসতে হয়েছে যেমন সঠিক, তেমনি সঠিক হওয়ার কথা এখানেই মানব সভ্যতার অন্যতম আদি জন্মভূমি (একটি জায়গা থেকে সকল মানুষের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার হাইপোথিসিস এখন ভেঙ্গে পড়ার মতো নাজুক অবস্থায় আছে)। সমস্যাটি ঠিক এখানেই, আমরা পুস্তকায়িত সমাজ পুস্তকের বাইরে কোনো কিছুই মানতে প্রস্তুত নই।
যদি বলা হয়- বাংলা অঞ্চল সভ্যতার অন্যতম জন্মভূমি; অনেকেই যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বক্তাকে নিধন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন অথবা পাগল আখ্যা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন। আমাদের বক্তব্য হলো- আপনি অযথা ক্ষিপ্ত না হয়ে ভাবতে বসুন, সভ্যতার সূচনা হওয়ার জন্য কি কি অনুষঙ্গের উপস্থিতি প্রয়োজন, এর কোনটি সৃষ্টির শুরু থেকেই এই উপমহাদেশে অনুপস্থিত অথবা আপনি যেসব তীর্থভূমিকে সভ্যতার জন্মস্থান হিসেবে চিনে এসেছেন তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোন কোন বিষয়ে যে সেখানেই ভাষা-সভ্যতা-মানুষের জন্ম হতে হলো? আপনি শিখেছেন কোন উপনিবেশিত বিদ্যালয়ে অথবা ঐসব বিদ্যালয়ে শিক্ষিত পণ্ডিত মহলের প্রচারিত জ্ঞানের মাধ্যমে এবং ওসব তত্ত্ব ও তথ্যকে অকাট্য ভেবে মাথা পেতে নিয়েছেন। উপনিবেশিক শক্তির প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো উপনিবেশিতের মগজকে তার ইচ্ছমতো পরিচালিত করা, তাতে তাদের সকল বাসনাই সঠিকভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আপনার চারপাশে আপনি দৃষ্টি দিতে ভুলে গেছেন। আপনি খেয়াল করেননি যে, শিখিয়ে পড়িয়ে আজ্ঞাবহ ভৃত্য বানিয়ে তোলার পেছনে কতখানি গভীর ষড়যন্ত্র লুকায়িত আছে। আপনি ভুলে গেছেন শিখিয়ে দেয়া, উদ্ধৃত করা বুলি ও তথ্যের বাইরে একটি বিশাল জগত পড়ে আছে। সেই জগতের ভাষা, স্থানীয় পরিচয় ও বিভিন্ন সংকেত আছে। এই সংকেত বা নিদর্শনগুলো কীভাবে কাজ করে এবং তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিবেচনার বাইরে রেখে বিদেশি বিভাষী ও তাদের অক্ষম অনুকারীদের রচিত পুঁথি-পুস্তকের আগ্রাসী চর্চা বাঙালি এবং তার ভাষাকে ক্রমাগত হীনবল করে তুলছে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্রের উদাহরণ নতুন নয়, মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম এদের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা ও প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে লিখেছিলেন ‘বঙ্গবাণী’ কবিতা। কথিত আধুনিক যুগের সূচনাকালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘হায় হায় পরিতাপে পরিপূর্ণ দেশ। দেশের ভাষার প্রতি সকলের দ্বেষ।’
উত্তরাধুনিক সময়েও এমন বঙ্গবাণী কবিতা লেখার দুর্ভাগ্য হতে পারে কারো। কারণ এই অঞ্চলের বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশের লেখক চিন্তককুলের ভাষা-ভূমি-সত্তা-প্রকৃতি ও পরিচিতি সম্পর্কিত বিভ্রান্তি উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভাষা গবেষক কলিম খান লিখেছেন, ‘কোনো জাতির সমস্ত অর্জিত সম্পদের বৃহত্তম কোষাগার তার ভাষা, ভাষা চলে গেলে তো তার কৃতি, সংস্কৃতি, বিশ্বদর্শন সব চলে যাবে। তাই এ ব্যাপারে কোনো জাতিই কোনোরকম জায়গা ছেড়ে দিতে সহসা রাজি হয় না। আবার বিপরীতে, কোনো জাতির ভাষাকে মেরে ফেলতে পারলে, সেই ভাষাহীন জাতিটিকে না মারলেও চলে।’ ভাষা বিষয়ে সংবেদনহীন লেখক সমাজ জাতির জন্য কোন সুসংবাদ বয়ে আনতে পারে এমন দুরাশা ছেড়ে দেয়াই মঙ্গল। হয়তো অল্প কিছুদিনের মাঝে আবার রোমান বা আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার দাবি উঠতে পারে (বিষয়টি অতিকথন মনে হতে পারে কিন্তু চোখ কান যাদের খোলা আছে তারা আভাস পাওয়ার কথা)। ভাষাকর্মী আর কবি-সাহিত্যিক-চিন্তকগণ খুব দ্রুত গতিতে বাংলা ভাষাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও বিকৃত করার প্রক্রিয়া অব্যহত রেখেছেন। (ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও বিকৃত করার কথায় অনেক চোখা প্রশ্ন অনেকেরই থাকবে, বিষয়টি কেবলই ধারালো প্রশ্ন এবং বিদ্রূপ-বিবেদ-বিদ্বেষ-স্যাটায়ার-স্বক্ষমতার না; অনুভূতির গভীরতর আত্মদর্শনেরও বিষয়।) তাদের যুক্তিরও বোধ করি অভাব নেই। এর প্রধান কারণ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে সবার ভিতরেই একটি বদ্ধমূল ধারণা হলো এই জাতি এবং ভাষা নিঃসন্দেহে সংকরজাতি ও মিশ্রভাষা (জাতি এবং ভাষাকে জারজ/মিশ্র/সংকর প্রমাণের প্রকল্পগুলো সুসম্পন্ন)। কিন্তু কারো মনেই প্রশ্ন তৈরি হয় না কোন জাতি সংকর নয়? কোন ভাষা মিশ্রণ মুক্ত? তাহলে আলাদাভাবে বাংলার উপরে এই বিশেষ অপযুক্তি চাপিয়ে দেয়ার কারণ কী?
আমাদের কথিত অভিজাত শ্রেণি আন্তর্জাতিকতার নামে ইংরেজির প্রচলনে ব্যস্ত, অপরপক্ষ তাদের ধর্মীয় অবস্থান ও পরিচিতি জানান দেয়ার জন্য জবরদস্তিদূলক বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ও পূনর্বাসনের কাজটি করে যাচ্ছেন বেশ যত্নের সঙ্গে; (এখানে বলে রাখা ভালো অনেক বিদেশি শব্দ আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করছে সেই সত্যটিও অস্বীকার করা হচ্ছে না) মাঝখানে পিষ্ট হচ্ছে বাংলা ভাষা, আমার দুখিনী রক্তাক্ত বর্ণমালা, আমাদের আত্মপরিচয়ের নিবিড় আশ্রয়ভূমি।