মাগুরার নিভৃত গ্রামের বছর আটের বালিকাটি তার খেলাধূলার খুব চেনাজানা পরিসরেই চিরতরে জায়গা করে নিল কবরে। নিস্তবদ্ধ করবের ওপরে বাতাসে রেখে গেল তার বাকিটা জীবনের নিঃশ্বাস, যা ভেসে বেড়াবে বাংলাদেশের বুকে; উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে। ‘আমাদের মেয়ে’ হয়ে ওঠা আছিয়ার শোক ব্যথা দিয়েছে বাংলাদেশের হৃদয়ে, সেই বেদনা বার্তা দিয়েছে নতুন করে জেগে ওঠার; ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের কাজীর পাড়া গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী সোনাকুন্ডি গ্রামের কবরস্থানে জায়গা হয় আছিয়ার। রাত পৌনে ৯টার দিকে তার মরদেহের দাফন সম্পন্ন হয়।
ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া আছিয়ার মরদেহ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। আছিয়ার জন্য জেগে ওঠা বাংলাদেশে তার অন্তিম দিনগুলোতে সে পেল বিরল সম্মান, চিকিৎসা। তার কফিন কাঁধে হাঁটল বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে আছিয়ার মরদেহ বহন করা হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। হেলিকপ্টার পৌঁছানোর আগে স্টেডিয়াম ঘিরে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ; ঢাকা থেকে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে; মাগুরার নানা গ্রাম থেকে আসে লোক। স্টেডিয়াম থেকে কফিনবন্দি মরদেহটি নিয়ে যাওয়া হয় মাগুরা শহরের নোমানী ময়দানে, যেখানে সন্ধ্যা ৭টায় প্রথম জানাজা হয়। জানাজায় চোখের জলে ফরিয়াদ করে তার জন্য দোয়া করতে দেখা যায় বহু মানুষকে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মরদেহ বহন করা হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে
শিশুটির মরদেহের সঙ্গে সামরিক হেলিকপ্টারে ছিলেন শিশুটির মা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
মাগুরায় ফরিদা আখতার বলেন, “এটা রাষ্ট্র বা সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে দেখছে। কারণ এত ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ের ধর্ষিত হওয়া মেনে নেওয়া যায় না। এটা কারো জন্য মেনে নেওয়া যায় না। শিশুটি আমাদেরই মেয়ে। কাজেই আমরা সেভাবেই দেখছি।”
‘আমার মেয়ের মতো কষ্টে তারেও দেখতে চাই’ ধর্ষণের ক্ষত নিয়ে কয়েক দিন ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা গেছে মাগুরার আট বছরের শিশু আছিয়া। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুর ১টার দিকে তার মৃত্যুর খবর জানায় সেনাবাহিনী। শিশুটির মৃত্যুর খবর শুনে বাকরুদ্ধ তার মা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন, বিলাপ করেন হাসপাতালের মেঝেতে।
তখন আছিয়ার মাকে বলতে শোনা যায়, “আমার মণি যেভাবে মরছে, আমি তারও (অপরাধীর) ফাঁস দিয়ে বিচার চাই। (তার) এরম মৃত্যু চাই আমি, আমার মণির যেমন বেলেড দিয়ে কাটছে, গলায় ফাঁস দেসে, ঠিক সেরকম বিচার চাই আমি আপনাদের কাছে। ওরে যেন ওইরকম ফাঁসি দিয়ে মারে। ওরকম যেন ওরে বেলেড দিয়ে কাটে। আমার মেয়েটারে যে কষ্ট দিছে না? আমি তারেও এরকম দেখতে চাই।”
রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মিছিল হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশালমিছিল ধর্ষকের বিচার নিশ্চিত করা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশালমিছিল হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বামপন্থি সংগঠনগুলোর আয়োজনে রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে এই মিছিল হয়।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে মশাল হাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে জড়ো হন বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। এরপর মোমবাতি হাতে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুর মৃত্যুতে শোক পালন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
পুলিশ যা বলছে মাগুরা সদর থানার ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, “কেউ যদি ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে বা এখন যেহেতু মারা গেছে, তাই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে হত্যা-সংক্রান্ত যে বিধান আছে, সে অনুযায়ী বিচার চলবে। সেভাবেই চার্জশিট দেওয়া হবে। যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন দেওয়া হবে।”
ধর্ষণের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ধর্ষণের ঘটনাগুলো দ্রুত উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রেখে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সচিবালয় সমসাময়িক বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা এ কথা জানান।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের কাজীর পাড়া গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী সোনাকুন্ডি গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয় আছিয়ার মরদেহ।
তিনি বলেন, ‘‘গত দুইদিন আপনাদের বলেছি, আমরা একটা নতুন আইন করছি। নতুন আইনের প্রাথমিক খসড়া হয়েছে। অনেক স্টেকহোল্ডার আছে, ওনাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। আমরা আশা করছি, আগামী রবিবার, খুব দেরি হলে সোমবার, আশা করছি রবিবারই নতুন আইন প্রণয়ন করে ফেলব।’’
আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, প্রধান উপদেষ্টা নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
সন্ধ্যা সাতটায় শহরের নোমানী ময়দানে শিশুটির প্রথম জানাজা হয়
মাগুরা পৌর এলাকায় বোনের (শ্বশুর) বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গত বুধবার (৫ মার্চ) রাতে শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয় বলে পরিবার জানায়। শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) শিশুটিকে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা সব আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে যায় আছিয়া।
আছিয়ার মৃত্যুর পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছিয়ার মৃত্যুতে দোষীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি তোলা হয়েছে।